পূজার দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠল সনাতন. ভোরের স্নান সারল. আগের রাতে পূজার জোগার জাগার করতে খুব খাটুনি গেছে. সেই সব শেষ করে সনাতনের ঘুমাতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গেছে. কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠবার জন্যে ও কোন আলস্যকে পাত্তা দেয় নি. স্নান পড়া শেষ হলে পায়ে পায়ে রূপা বৌদির বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে. হাতে একটা প্যাকেট. শহর থেকে নিজে পছন্দ করে শাড়িটা কিনে এনেছে. নীল রঙের ওপর. বৌদির নীল রঙ খুব পছন্দের. সনাতন বৌদির সাথে কথায় কথায় জেনে নিয়েছিল দিন কয়েক আগেই. আরে একটা ছোট বক্সে মানানসই রঙের কাঁচের চুড়ি. এই হল বৌদিকে দেবার মত ঊপহার.
রূপা বৌদির বাড়ি পৌঁছে দেখল রূপা ঘুম থেকে ওঠে নি. পরিতোস থাকে না বলে রূপা বৌদির কাছে সব উৎসব বিবর্ণ. রঙ চটা. ভগবানের কাছে ও প্রত্যেকদিন প্রার্থনা করে. তাই বিশেষ দিনে আর বিশেষ করে কিছু চায় না. সারাজীবন ধরে একটাই চাওয়া ভগবানের কাছে. একটা সন্তান. কিন্তুর উপরওয়ালার কোন দয়ার খবর এখনো পায়নি রূপা. তাই উৎসবের দিনে বাচ্চাদের আনন্দ দেখতে রূপা বৌদির সব চেয়ে ভাল লাগে. তাই মন্দিরে যায়. সবাইকে নতুন পোশাকে দেখে ওর পরিতোসের কথা মনে পড়ে যায়. বর পাশে থাকলে ওর ভাল লাগে, নাইবা থাকল কোন সন্তান.
দরজায় খটখট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রূপার. চোখ খুলে ঠাহর করতে পারল এটা কোন সময়. কাল বাপের বাড়ি থেকে ফিরেছে. সোনারপুর থেকে সাতগাঁর রাস্তা খুব কম না. শরীর ক্লান্ত ছিল. মরার মত ঘুমিয়েছে.
ভোর হয়ে গেছে খেয়াল পরতেই রূপা বিশ্রী গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে রে?’
সনাতন বাইরে থেকে উত্তর দিল, ‘বৌদি আমি.’
রূপা উঠে বসে কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘এতো সকালে কি চাই?’
কাল সন্ধ্যাবেলায় সনাতন কথা বলে গেছে রূপা বৌদির সাথে. বাপের বাড়ি কেমন কাটাল, শরীর ঠিক আছে কিনা, মন্দিরে যাবে কিনা ইত্যাদি.
সনাতন উত্তর দিল না. রূপা দরজা খুলে দিল. সনাতন ঘরে ঢুকে পড়ল.
সনাতন রূপাকে বলল, ‘এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছো কেন বৌদি?’
রূপার মন ভাল হয়ে গেল. এতো সকালে সনাতন এসেছে বলে.
রূপা বলল, ‘আয় বোস.’
রূপা লক্ষ্য করল সনাতনের হাতে একটা প্যাকেট. কিসের প্যাকেট?
ওকে বেশি ভাবার অবকাশ না দিয়ে সনাতন হাত বাড়িয়ে প্যাকেট রূপা বৌদির মুখের সামনে ধরল, ‘বৌদি, এটা তোমাকে পূজার উপহার.’ এরকম চমক রূপাকে আগে কেউ কোনদিন দেয় নি. বাবা বা পরিতোস পর্যন্ত না. বাবার কাছে বা পরিতোসের কাছে একটা দাবি মত থাকত পূজার উপহারের জন্যে. মুখ ফুটে না বললেও. সনাতনের কাছে এমন উপহার কোন দিন পাবে স্বপ্নেও ভাবে নি. রূপাকে বেসামাল করে দিল এমন আনন্দের চমক . প্যাকেটটা নিল হাত বাড়িয়ে. প্যাকেটটা বিছানায় রেখে জড়িয়ে ধরল সনাতনকে রূপা.
সকালের আলোয় সনাতনকে বুকের মধ্যে পেয়ে রূপা এক রেশমের পেলবতা অনুভব করল. ভোরের শিশির ওর মনকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল. প্রভাতের সূর্যের নরম কিরণের মত সনাতনের ভালবাসা. গায়ে মেখে নিল. রূপা ভাবল কেন ওর ভাগ্য এতো ভাল হল না যে পরিতোস সফিকের মত হল না. পরিতোসের কথা না ভেবে সনাতনকে জড়িয়ে ধরল. শক্ত করে. লম্বা সনাতনের বুক পর্যন্ত রূপা মাথা. আলতো করে সনাতনের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে রূপা. মনের মধ্যে সুখের ফল্গু বয়ে চলেছে. সনাতন যে তার কাছে ভগবানের বড় দান. ওর ভালবাসা সব থেকে বড় পূজার উপহার. কখন দুচোখ জলে ভরে গেছে রূপা বুঝতে পারে নি. গাল বেয়ে নেমেছে. হুঁশ ফিরল সনাতনের কথায়. ‘বৌদি কাঁদছ কেন? পরিতোসদা তো কাজে গেছে. এরপর একেবারে চলে এলে আর কোন কষ্ট থাকবে না তোমার.’ সনাতন রূপাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল. রূপা সনাতনকে বোঝাতে চাইছে না কিসের দুঃখে বা সুখে রূপা বৌদির চোখে জল. এমনও ভালবাসা ওর জীবনে আসতে পারে ভাবে নি রূপা. এক সময় রূপা ছেড়ে দেয় সনাতনকে.
সনাতন বলল, ‘বৌদি শাড়িটা পরবে কিন্তু. এখন চলি.’
রূপা বৌদির সনাতনকে ছাড়তে ইচ্ছা করছে না. মন চায় আজ উৎসবের সারাটা দিন একসাথে কাটায়. মন চাইলেও হবে না. ওদের সম্পর্ক সমাজ স্বীকৃত নয়, কোন দিন হবেও না.
রূপা বলল, ‘সন্ধ্যাবেলা আসিস.’
সনাতন মাথা নেড়ে বেরিয়ে পড়ে. সুন্দর একটা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছে. সকালের সূর্য্যের আলো ওর শরীরে পড়ছে. রূপা দেখল সনাতন আলের ওপরে উঠল, চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে ধীরে ধীরে. রূপা আর শুল না. সুন্দর করে কাটাতে চায় পূজার বিশেষ দিন. মন চেয়েছে পূজার দিনটা ভাল কাটুক. পরিতোস পাশে না থাকার দুঃখ ভুলে উৎসবে মেতে উঠবে রূপা.
গোটা সাতগাঁ জুড়েই খুশি পরিবেশ. ছোট ছোট বাচ্চারা মেতে উঠেছে পূজার আনন্দে. দুর্গা পূজা ষষ্ঠীর দিনে ভাল করে শুরু হয় না. কিন্তু বাচ্চাদের বোঝায় কার সাধ্যি! কত ক্ষণে ঠাকুর প্যান্ডেলে আসবে আর ওরা নতুন নতুন জামা প্যান্ট পরে বেরবে সেই সময়ের প্রতীক্ষায় থাকে. ঠাকুর এলেই ঠাকুমা, বাবা, দাদা বা দিদি যে কারো হাত ধরে চলে আসে. স্কুলের সামনে মাঠ আছে. স্কুলের মাঠে প্যান্ডেল বেঁধে পুজা হয়. প্যান্ডেলের সামনের মাঠে নানা রকমের স্টল বসে. বাজি, খেলনা বন্দুক, রঙ বেরঙের বেলুন, তেলে ভাজা, অন্যান্য খাবার মানে চিনে খাবার, মোঘলাই খাবার আরও কত কি! কিছু লোক পূজার এই সময় দুই পয়সা রোজগার করে নেবার সুযোগ হারাতে পারে না. ছোটদের ওপর খবরদারি নেই. বেশ একটা আলগা আলগা ভাব. সারাদিন রূপা সনাতনের চিন্তা করে গেছে. সকালে ভালবাসার যে সুর সনাতন রূপা বৌদির মনের ভিতরে বাজিয়ে দিয়ে গেছে সেটার রেশ রূপা বৌদির মনের মধ্যে থেকে গেছে. রিনরিন করে বেজে যাচ্ছে সারাদিন. মন খুঁজে বেরিয়েছে সনাতনকে. সনাতনের দেখা মেলে নি. সারাটা দিন ছেলেটা কোথায় থাকে কে জানে! দুচোখে সনাতনের জন্যে তৃষ্ণা. তৃষ্ণা মেটে নি. রূপা ভাবল কেন যে সন্ধ্যাবেলা আসতে বলেছিল, দুপুরে বললে তো দুপুরেই আসত সনাতন. যা হবার হয়ে গেছে. রূপা বেরিয়ে গ্রামের অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাত করেছে. অনেকের সাথে কথা বলেছে. খুব স্বাভাবিক ভাবেই দিন কাটিয়েছে.
বাজার থেকে মাংস কিনে এনেছে রূপা. সনাতনের জন্যে রান্না করবে আজ. তেল, মশলা কিনেছে. বাড়ি ফিরে এসে মাংস তেল ও নানা মশলা মেখে কচু পাতায় রেখে দিল. বেলা পরে এলে রান্না করতে শুরু করল রূপা. দুপুরে ভাত খেয়েছে. সাধারণ ডাল ভাত. মাংস রান্না করলে দুপুরে খেতে পারত. কিন্তু একা একা খেতে ইচ্ছা করে নি. সন্ধ্যাবেলা সনাতন আসবে জানে. সেরে ফেলল মাংস রান্না . সনাতন এলে ভাত বসাবে. নিজের অভ্যাস মত সন্ধ্যা নামলে মাঠে গিয়ে নিত্যদিনের প্রাকৃতিক কর্ম সেরে স্নান করে নিজেকে পরিস্কার করে নিল. মনে মনে খুশির গান বাজছে রূপা বৌদির. স্পষ্ট করে না হলেও গুনগুন করছে রূপা. কানটা রূপার মুখের সামনে নিয়ে গেলে শোনা যাবে. সন্ধ্যাবেলা সনাতন এলো রূপা বৌদির ঘরে. টিভি দেখছিল রূপা. একটা বাংলা সিরিয়াল চলছিল. সনাতন ঢুকলে বন্ধ করে দিল টিভি. দেখল সনাতনকে একটা পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে. পাজামা পাঞ্জাবী পরেছিল. সকালে যেটা ছিল এটা অন্য. সাদা নয়. হালকা রঙিন. রূপা ভাবল সনাতনদের নানা রকমের পোশাক কেনার ক্ষমতা আছে. সনাতনের চোখের দৃষ্টি নরম. রূপা বৌদির ভাল লাগল. সনাতন বলল, বৌদি পান এনেছি. খাবে?’
রূপা বাস্তবে ফিরে এলো, খাব. তোর জন্যে মাংস রান্না করেছি. এখন রান্না ঘরে চল. ভাত বসাবো.গরম গরম খেয়ে নিবি আমার সাথে.
রূপা সনাতনের কাছে থেকে পান নিল. রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াল. পিছন পিছন সনাতন গেল রান্না ঘরের মধ্যে. দেখতে সুন্দর লাগছে বৌদিকে. রূপা চাল মাপল. জল দিয়ে ধুয়ে নিল. হাঁড়িতে চাল ফেলে উনুনে আগুন জ্বেলে দিল. কাঠ পুড়িয়ে রান্না রান্না করে সাতগাঁর মহিলারা. রূপা ব্যতিক্রম নয়. কাঠ উনুনে ফেলে ভাত রান্না করতে শুরু করে দিল. সনাতন কথা না বলে রূপাকে দেখতে লাগল. রূপা নীরবে রান্না করতে লাগল. ওর জন্যে রান্না করছে ভেবে ভাল লাগল. বৌদি ওর বউ হলে নিত্যদিন ওর জন্যে রান্না করত. সনাতন ভাবতে লাগল বৌদি কত পাল্টে গেছে. আজ একেবারে নতুন বউ লাগছে. মুখে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব. চুরি করে সনাতনকে মাঝে মাঝে দেখছে. যেন কিশোরী তার নতুনকে প্রেমিককে দেখছে. ভাত হয়ে গেছে. রূপা ফ্যান ঝরাতে দিল. খানিক সময় পরে ভাতের হাড়ি তুলে নিল রূপা. একটা থালায় ভাত বেড়ে দিল. ধোঁয়া উড়ছে. রূপা অনেক রান্না করে নি. ভাত, মাংস, চাটনি. সনাতন দেখল একটা থালায় ভাত বেড়েছে. মানে ওকে আগে খেতে দেবে. কিন্তু সনাতন একসাথে খেতে চায়.
সনাতন বলল, ‘বৌদি একলা খাব না, তুমিও বেড়ে নাও. একসাথে খাব.’
রূপা বলল, ‘না না তা হয় না. তুই আগে খা, তারপর আমি খাবো.’
সনাতন বলল, ‘একসাথে খেলে কি হবে? খাওয়া হলে ঘরে গিয়ে একটু ফ্যানের নিচে বসতে পারি.’
রূপা ওর কথা কিছুটা অনুমান করে নিল, বলল, ‘খেতে খেতে তোর যদি কিছু লাগে? তুই আগে খায়ে নিলে আমি সেইমত খেয়ে নিতাম.’
সনাতন বলল, ‘কিছু লাগবে না. যদি কিছু লাগে তাহলে খেতে খেতে দিও.’
সনাতন জোর করলে বলে রূপা নিজের জন্যে খাবার থালায় বেড়ে নিল. দুজনে খেতে শুরু করল. রূপা অনেকদিন পর মাংস খাচ্ছে. পরিতোস থাকে না বলে ওর ইচ্ছাগুলো মরে যাচ্ছিল. সনাতনের জন্যে রান্না করেছিল বলে নিজেও খাচ্ছে.
সনাতন বলল, ‘বৌদি মাংস দারুন রেঁধেছ. আমার মাও এমন পারে না.’ রূপা নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে খুশি হল, কিন্তু মুখে বলল, ‘তুই কি যে বলিস না! তোর কথা শুনে আমার ছাগলও হাসবে. তোর মা সাতগাঁর সব চেয়ে বড় রাঁধুনি.’
সনাতন আর একটা গ্রাস মুখে ফেলে বলল, ‘সে হতে পারে. কিন্তু খেয়ে আমার যা মনে হল তাই বললাম.’
রূপা বলল, ‘আর একটু নিবি?’
সনাতন বলল, ‘তোমার কম পড়বে না তো?’
রূপা বলল, ‘না না, তুই পেট ভরে খা.’
রূপা সনাতনকে মাংস দিল. ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল. সনাতনকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রূপা বাসন ধুয়ে ফেলল. তারপর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল.
রূপা বলল, ‘তোর শাড়ি আর চুড়ি আমার খুব পছন্দ হয়েছে.’ রূপা বৌদির চোখে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ.
সনাতন জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে শাড়ি পরে কেমন দেখাচ্ছিল?’
রূপা বলল, ‘তোকে সারা দুপুর দেখলাম না.কোথায় ছিলি? আমি তো সারাদিন তোর শাড়ি গায়ে জড়িয়েছিলাম.’
সনাতন মনে মনে ভাবল শাড়ির থেকে ওকে জড়ালে সনাতন বেশি খুশি হত. সনাতন বলল, ‘হাটে গেছিলাম পূজার কেনাকাটা করতে তারপর বাবুয়ার সাথে ছিলাম. আরেকবার পরবে?’
রূপা চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এখন?’
সনাতন মৃদু স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ.’
রূপা বলল, ‘কি যে করিস না! যখন পরেছিলাম তখন বাবুর পাত্তা নেই. এখন আবার হুকুম করা হচ্ছে. যা ঘরের বাইরে যা, আমি পরছি.’
সনাতন অবাক করা গলায় বলল, ‘আমাকে বাইরে যেতে হবে?’
রূপা বলল, ‘হ্যাঁ, আমার লজ্জা করবে না?’
সনাতন ভেবে পায় না বৌদির আবার ওর সামনে কিসের লজ্জা করবে. গুদুসোনা পর্যন্ত সনাতনের মুখের ছোঁযা পেয়েছে, তারপরেও এতো লজ্জা বৌদি কোথা থেকে পায় কে জানে!
সনাতন বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে?’
রূপা বলল, ‘মিনিট দশেক.’
দশ মিনিট পর কি হল আরেকদিন …..