বাংলা চটি উপন্যাস – অনুদি বলল, তোর ছেলে কোথায়?
মেয়েটি হেসে বলল, দস্যিপনা করে এখন মার কাছে ঘুমোচ্ছে।দাড়ান,আনছি।
–না থাক ঘুমোক।মাসিমার শরির কেমন আছে?
ভীতর থেকে কে যেন ডাকলেন, কে এলরে ইন্দ্রাণী?
–অনুদি এসেছেন মা।
অনুদি আমার কাছ থেকে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে তার ভিতর থেকে একগোছা টাকা বের করে ইন্দ্রাণীর হাতে দিল। একটু ইতস্তত করে টাকাটা নিয়ে বলল, দিদি মামলা কতদিন চলবে? আর ভাল লাগছে না।
–তোকে ওসব ভাবতে হবেনা। তোকে যা বলেছি মন দিয়ে কর। পিএসসি পরীক্ষা এগিয়ে এল।তোর উপর অনেক ভরসা আমার।
মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ইন্দ্রানি,তারপর বলে ,দিদি বোসো চা করি।
–না বসবো না,অনেক কাজ আছে।আসিরে।
নীচে নামতে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল,অপা আমি কুদ্দুস।
–ওঃ ভাইজান? কেমন আছেন?
–আপনি এসেছেন দেখে আসলাম।
–কোন অসুবিধে হচ্চেনা তো?
–অপা আপনি কিছু ভাববেন না।আপনার ভাইজান থাকতে কোন হারামি ওদের ক্ষতি করতে পারবে না।কুদ্দুসের চোখ জ্বলে উঠল।
–সেই ভরসাতে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারছি।কোন দরকার হলে আমার স্কুলে চলে আসবেন। এখন আসি?
পাখিরা বাসায় ফিরে গেছে, একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। এবার অন্য পথে চলেছে অনুদি। ক্রমশ রহস্যময়ী হয়ে উঠছে অনুদি।কুদ্দুস মুসলমান একটা হিন্দু মেয়েকে রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে।যত দেখছি তত জানছি।
–কিরে অত দূরে থাকলে কথা বলবো কি করে? পাশে পাশে আয়।
বড় বড় পা ফেলে অনুদির পাশে যেতে জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলি?
–কিসের কথা বলছো?
–আমি ইন্দ্রাণীর কথা বলছি।
–মহিলা বেশ সুন্দরি।
–ইন্দ্রাণী পলাশ পুরে থাকতো,আমার ছাত্রী। ওর রুপই ওর কাল হয়েছে।
–আপনা মাংসে হরিণা বৈরী। আমি চর্যাপদের শ্লোক আওড়ালাম।
–বাঃ বেশ বলেছিস তো। রুপই মেয়েদের শত্রু। ক্লাস টেনে উঠে এক ঠগের পাল্লায় পড়েছিল, তার বোলচালে ভুলে বিয়ে করে।পরে জানা গেল ছেলেটির কোন উপার্জন নেই বেকার ইন্দ্রাণীকে বিপথে নেবার চেষ্টা করে।বুদ্ধিকরে তার খপ্পর থেকে বেরিয়ে আমাকে সব জানায়।ডিভোর্সের মামলা চলছে,আমি ওকে নিজের পায়ে দাড় করাবার চেষ্টা করছি।আমার বিশ্বাস ও পারবে।
–কিন্তু আমাকে এখানে আনলে কেন তা কিন্তু বলনি।
–তুই ওকে বিয়ে করতে পারবি?
–কেন পারবো না?
–বিয়ে করে খাওয়াবি কি?
–সেই একটা সমস্যা। অনুদি আমি একটা অপদার্থ আমাকে দিয়ে তোমার কোন কাজ হবেনা।
–কি করে বুঝলি?
–বোজোদি বলত গোসাই তোমার বড় দোষ তুমি বানিয়ে কথা বলতে পারো না।
অনুদি ভ্রু কুচকে আমাকে লক্ষ্য করে কি যেন বোঝার চেষ্টা করে। তারপর বলে, একটা কথা বলি হয়তো একটু রুঢ় শোনাবে।তুই একটা অলস গা-বাচানো স্বার্থপর মায়ের কষ্ট না-বোঝা কি বলবো যাচ্ছেতাই–।
–থাক আর বলতে হবেনা।অনুদি তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করে আনন্দ পেতে চাও–পাও। কিন্তু আমার জন্য চিন্তা করনা।
–কিজানি কেন চিন্তা করছি? আসলে আমি জীবনের অপচয় সহ্য করতে পারিনা।মনুষ্যত্বের স্খলন আমাকে যন্ত্রণা দেয়।
অনুদি কবি তাই হয়তো উপলব্ধিগুলো এত সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারে।আমরা একটা নদীর কাছে চলে এসেছি। নদীর ধারে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। চাদের আলোয় ঝিলমিল করছে নদীর জল।
–এটা কি নদী অনুদি?
–নদীর নাম রুপাই।হিজলতলিতে দেখেছিস এখানে বন্য রূপে।
গদ গদ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনুদি।আমার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,তুই সিগারেট খাস?
বাংলা চটি উপন্যাস ৫ম পর্ব
–কখনো খেয়েছি এক-আধটা।
–মাঝে মাঝে মন ভারাক্রান্ত হলে এখানে আসি।বসে বসে শুনি রুপাইয়ের রূপ কথা।কত কথা বলে যায় নীরবে।
ব্যাগের ভিতর থেকে সিগারেট বের করে আমাকে একটা দিল,নিজেও একটা ঠোটে গুজে ধরাল। ইতিপুর্বে অনুদিকে সিগারেট খেতে দেখিনি।কবিদের জীবন যাপনই আলাদা।একরাশ ধোয়া ছেড়ে অনুদি আবৃত্তি করে,
নদীর বাতাসে শোন বিলাপের ধ্বনি
বালির অতলে জল কাপে নিরবধি শুনি
আমিও এসেছি আজ রুপাইয়ের তীরে
তোমার পায়ের চিহ্ন খুঁজে অগোচরে
আমি শুধু শূন্য গুনি, গুনে মন ভোর
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।
কি সুন্দর লাগছে দেখতে অনুদিকে চাদের আলোর সিলুয়েটে। অনুদি কার পায়ের চিহ্ন খুঁজে ফিরছে?কি দুঃখ অনুদির জানি না,খুব ইচ্ছে করে অনুদির জন্য কিছু করি।কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারি আমার সামর্থ্য কতটুকু?কারো জন্য কিছু করতে হলেও যোগ্যতা থাকা চাই।নিজের অপদার্থতার জন্য খুব রাগ হয় নিজের উপর।ভোলা বলে আমি ভাল মানুষ।এই ভাল মানুষীর কি মূল্য আছে?
আধার নেমে এসেছে। অনুদিকে এক ঘোরের মধ্যে মনে হয়। দুজনে বসে আছি পাশাপাশি। রুপাই নাকি রূপকথা বলে? অদ্ভুত লাগে অনুদির কথা। জিজ্ঞেস করি ,তুমি রুপাইয়ের কথা শুনতে পাও?
অনুদি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন, শোনা যায় না উপলব্ধি করতে হয়। দুই পাড়ে নিত্য ঘটে চলেছে কত অত্যাচার অবিচার অনাচার তার নীরব সাক্ষী এই রুপাই। রুপাই আমাদের মায়ের মত তা সত্বেও অকৃতজ্ঞ-পাষণ্ড সন্তানদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নেয়নি রুপাই।স্নেহ-মমতা দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে।
নতুন কথা শুনছি।এইসব কথা যেন আমার বুকে চাপা ছিল এতদিন।অনুদির কথায় যেন দরজা খুলে গেল।
–তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? অসুবিধে থাকলে বলিস না।
–কি কথা বলো,তোমাকে আমি সব কথা বলতে পারি।
–ব্রজবালার সঙ্গে তোর কেমন সম্পর্ক ছিল?
–জানো অনুদি বোজোদি আমাকে খুব ভালবাসতো–।
–তা নয় তুই কিছু করিস নি তার সঙ্গে?
অনুদি কি ইঙ্গিত করছে? অনুদি আর পাঁচজনের মত নয়।বোজোদির কথা মনে পড়ল।জানো অনুদি, বোজোদি বলতো, গোসাই তোমার-আমার একদিন মিলন হবে। বিশে-কেলোরা আমার নামে মিথ্যে বদনাম দিয়ে বাবার কাছে মার খাইয়েছে।জানো আমার মা বিশ্বাস করেনি এমন কি দময়ন্তীও–।
–তুই কোন মেয়ের সঙ্গে কোনদিন কিছুই করিস নি?
কি জানতে চাইছে অনুদি? হঠাৎ এসব কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? কিছু কি শুনেছে?
–থাক তোকে বলতে হবেনা।অনুদি প্রসঙ্গ বদলাতে চায়।
অনুদি নদীর দিকে তাকিয়ে বলে, তোর মধ্যে কোন হিপোক্রিসি নেই তুই খুব সরল।তোর এই গুণ মেয়েদের আকর্ষণ করে বেশি।
–কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি কথাটা বলিনি।
–মিথ্যে করে বানিয়ে বলতেওএ পারিস নি।
–বলিনি, শুনলে আমাকে ঘেন্না করবে।বিশ্বাস করো আমি না, রেবতী বউদি জোর করে–।
–কে রেবতী?
–পলাশপুরে থাকে অতুলদার বউ। অতুলদা তাকে সুখি করতে পারেনি। একদিন রাতে ঘুমিয়ে আছি আচমকা–।
–ওই একবার? আর কখনো কারো সাথে–।
–মলিনাবৌদি–
অনুদি অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে,যার স্বামী জেলে আঁছে?
–হ্যাঁ। একদিন একটা পুটুলি আমাকে রাখতে দিল। কদিন পর সেই পুটুলি ফেরত দিতে গেলাম–।
–কি ছিল পুটুলিতে?
–তখন জানতাম না পরে জেনেছি–সোনা ছিল।
–ও ঐজন্য পুলিশ কিছু পায়নি?তুই খুব ঝুঁকির কাজ করেছিস অবশ্য না জেনে–।
–মলিনাবৌদি কি রকম আকুতি-মিনতি করতে লাগল তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ভীষণ কষ্ট হল আমি না করতে পারলাম না। অনুদি তোমার খুব ঘেন্না হচ্ছে তাই না?
অনুদি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে তারপর স্মিত হেসে আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে, আমার কাছে তোর সম্মান অনেক বেড়ে গেল। তুই এক নতুন অভিজ্ঞতা তোকে কথা দিতে হবে আমি যা বলবো তুই করবি?
–কঠিন কাজ না হলে করবোনা কেন?
অনুদির বুকের উষ্ণতায় মন সতেজ হয়ে উঠল।
–এবার ওঠ,তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরতে হবে। পরশুদিন একটা বই প্রকাশ উপলক্ষে বাড়িতে কয়েকজনকে ডেকেছি–অনেক কাজ বাকি।
–কি হবে সেখানে?
–কবিরা আসবে, কলকাতা থেকেও আসবে কবিতা-পাঠ আলোচনা–তুই আসবি?
–আমি কি করবো?আমি কি কবিতা লিখি?
–শুনতে ভাল লাগেনা? শুনবি–।চল, এখান থেকে স্টেশন বেশি দূর না।
অনুদির হাত আমার কাঁধে একটা সুন্দর গন্ধ অনুদির গায়ে। একসময় অনুদি বলে, তুই আজ আমাকে যা বললি আর কাউকে বলবি না। তুই জানিস ব্রজবালাকে কে খুন করেছে?
–মলিনাবৌদি বলেছে নকুড়দালাল রেপ করে খুন করেছে।
–মলিনা কি করে জানলো?
–সঙ্গে কেলোরা ছিল।ওদের সঙ্গে বৌদির খুব ভাব।বোজোদি কারও কোনো ক্ষতি করেনি।
–মলিনাকে এড়িয়ে যাবি,কোথা থেকে বিপদ আসে কে বলতে পারে।
আমার কাঁধে অনুদির ঝোলা তার উপর কাঁধে অনুদির হাত চলতে অসুবিধে হচ্ছে।কিছুক্ষণ নীরবে চলার পর অনুদি জিজ্ঞেস করে, তুই কাউকে কোনদিন ভালবেসেছিস?
–ওসব বিলাসিতা আমাকে মানায় না।
–না মানাবার কি আছে?
–বারে আমার কি টাকা আছে?টাকা না থাকলে কে আমাকে ভালবাসবে বলো?
–তুই এত জানলি কি করে?
–দাদাকে দেখলাম না? বড়লোকের মেয়ে দেখে সব ভুলে গেল।
–সব মেয়ে টাকার জন্য ভালবাসেনা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে অনুদি।
মনে মনে ভাবি অনুদির দুঃখের ভাগ আমি কোনোভাবে আমি কি নিতে পারিনা? অনুদি বড় চাপা নিজের দুঃখের ভার কাউকে শেয়ার করতে চায় না। বড় রাস্তায় পড়তে অনুদি কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে বলল, দে আমার ব্যাগ দে।
ট্রেনে উঠে অনুদি গম্ভীর অন্য চেহারা। হিজলতলিতে নেমে বলল, পরশু আসবি কিন্তু অনেক কথা আছে।
রিক্সার প্যাক প্যাক ধ্বনিতে মুখর স্টেশন চত্বর। মা বলেছে বেশি দেরি করবিনা। দ্রুত পা চালালাম বাড়ির দিকে। মেয়েদের বুকের উষ্ণতা কি প্রেরণা সঞ্চার করে? রুপাইয়ের তীরে অনুদির বুকে মাথা রেখে সেরকম অনুভূতি হল। রমেশদার বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম।জানলায় দাঁড়িয়ে মলিনাবৌদি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।দেখলেই আমাকে ডাকতে পারে।অনুদি বলেছে এড়িয়ে চলতে আমি একটু ঘুরে অন্য পথ ধরলাম।
সব মেয়ে টাকার জন্য ভালবাসেনা।তাই কি?জানি না অনুদি কোন ভালবাসার কথা বলল।বোজোদি আমাকে ভালবাসতো,খাওয়াতো কিন্তু কোনোদিন হাত পেতে কিছু চায়নি।বলতো গোসাই তোমারে চোখে দেখলেই আমার শান্তি।শুধু চোখের দেখাতেই কি শান্তি পাওয়া যায়? আর কোনো চাহিদাই নেই? অনেকক্ষন না দেখলে বা ফিরতে দেরী হলে মা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখেছি।ফিরলে অনুযোগ করতো,সারাদিন কোথায় থাকিস,মার কথা মনে পড়েনা?বেলা হচ্ছে দেখে কি দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
আমার কাছে রুপাই নদী নতুন নয়, কাল অনুদির দৌলতে রুপাইয়ের এক নতুন রূপ দেখলাম । তাদের চারপাশে ঘটে চলা প্রতিনিয়ত সাধারণ ঘটনাকে কবিরা এভাবেই দেখে । বলেন্দ্র মোহনের ডায়েরি পড়তে পড়তে যেভাবে বিস্মৃত অতীত জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে রুপাই যেন নিরন্তর লিখে চলেছে সেইভাবে সময়ের দিনলিপি।মলিনাবৌদির কথা শুনে অনুদি কিছু মনে করেনি।নিজের বুকে আমার মাথা চেপে ধরে আদর করেছিল।সুর্য বা আগুণের তাপ নয় অনুদির বুকে এক অন্য রকম তাপ যা মনকে উজ্জীবিত করে।সব মেয়ের বুকেই এরকম উষ্ণতা থাকে?বোজোদি যখন জড়িয়ে ধরতো এরকম হত। ভাবছি একবার লাইব্রেরিতে ঘুরে আসবো, বরেনদার সঙ্গে কথা বলতে বেশ লাগে।বরেনদা কবি নয় অফিস থেকে ফিরে লাইব্রেরি খুলে বসে বইয়ে ডুবে থাকেন সারাক্ষণ।আমাকে দেখেই বরেনদা জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার মনোজমোহন? অনেকদিন পরে এলে? দাদার সঙ্গে যোগাযোগ হল?
–শুনেছি দাদা এদেশে ফিরেছে।এখনো যোগাযোগ হয়নি।
–কাল কোথায় গেছিলি?
ছোটো অঞ্চল কোনো খবর চাপা থাকে না বললাম,অনুদির সঙ্গে মাজদিয়া। রুপাইনদী ওদিকটা অন্যরকম। আপনি দেখেছেন বরেনদা?
–হিজলতলিতে অনেক ময়লা জমেছেরে–নদীর চেহারা বদলে দিয়েছে।আক্ষেপের সুর বরেনদার গলায়।
বরেনদার কথা কখনো কখনো দুর্বোধ্য মনে হয় বুঝতে পারিনা।তা হলেও শুনতে ভাল লাগে। একটা বই পালটে বেরোতে যাবো বরেনদা জিজ্ঞেস করেন, সেদিন মানিকের দোকানে কি হয়েছিল রে?
মনে পড়ল সেদিন কেলোর সঙ্গে গোলমালের কথা। বললাম, মানিকদার সঙ্গে কথা বলছি কেলো এসে ফালতু চমকাতে এল–।
–ওদের এড়িয়ে চলাই ভাল,সমাজের দুষ্ট ক্ষত। তারপর কি ভেবে বললেন, গায়ে ময়লা পড়লে তো গা ঝাড়া দিতেই হবে।
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পার্টি অফিস অতিক্রম করে কিছুটা যেতেই ভোলা এসে দাঁত বের করে বলল, মনাদা খেল জমেছে।হি-হি-হি।
–তোর চাকরির কিছু হল?
–ধ্যুৎ কল্যাণদা দেবে চাকরি? ফিস ফিস করে বলল, এবার কল্যানদার ক্যালানি খাবার সময় হয়ে এসেছে।হি-হি-হি।
–কে ক্যালাবে?
–নকুড় দালালের সঙ্গে কিচাইন হয়ে গেছে,শালা পালটি খেয়ে এখন রঞ্জিতদাসের গ্রুপে ভিড়েছে,হি-হি-হি।
ভোলা এসব কি কথা বলছে?ওর এতে এত আনন্দ কিসের? ভোলার বিধবা মা লোকের বাড়ী কাজ করে ছেলের মুখে অন্ন যোগায়।মা চিরকাল থাকবেনা,কি করবে তখন ভোলা, কে দেখবে ওকে? বললাম, তোর এসব কথায় কাজ কি?চিরকাল চামচাগিরি করে কাটাবি? কিছু একটা করার চেষ্টা কর।
ভোলার মুখ করুণ হয়ে যায়। ভোলাকে রেখে এগিয়ে যাই ‘কিছু একটা কর’ কথাটা কানের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকে। আমি কি ভোলার থেকে আলাদা? খুব অসহায় মনে হয় নিজেকে। মনে হয় রুপাইয়ের ধারে গিয়ে বসে রূপকথা শুনি।
–মনাদা-মনাদা।
পিছন ফিরে দেখলাম ছুটতে ছুটতে আসছে ভোলা। আবার কি গোপন কথা বলতে আসছে।হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল,তোমাকে ডাকছে।
–তোকে বলেছি না আমি কারো হুকুমের গোলাম না?
–যাঃ বাবা আমাকে বলছো কেন? দিদিমণি বলল তাই বললাম। ভোলা একটু মনক্ষুন্ন।
দিদিমণি? তাকিয়ে দেখলাম দূরে দাঁড়িয়ে আছে অনুরাধাদি। কাছে যেতে বলে,কানে আজকাল কম শুনিস নাকি?
–আমি আজকাল কম শুনি কম দেখি, অনুদি আমি দিনদিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছি।
–যা বলছি মন দিয়ে শোন,খালি পাকা-পাকা কথা। ভেবেছিলাম সকালে আসবি,তোর কিসের যে এত ব্যস্ততা বুঝিনা।আজ তো হলনা–কাল সক্কালে উঠে শিয়ালদা এই ঠিকানায় চলে যাবি। সুদেষ্ণা আমার বন্ধু, ওকে এই বইটা আর চিঠিটা দিবি। কি বলে মন দিয়ে শুনবি।কিরে বুঝেছিস?
বইটা নিয়ে দেখলাম প্রচ্ছদে লেখা ‘রুপাইয়ের রুপকথা।’ তার নীচে অনুরাধা বসু।
–তোমার বই?
–হ্যাঁ। কাল অবশ্যই যাবি।সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে আসবি, মনে আছে তো?
–সেই কবিদের ব্যাপার? আমি কি করবো বলো?ইতস্তত করি।
— আমি বলছি তুই আসবি। একটা জিনিস পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
অনুদির চোখে রহস্যের আলো ঝিলিক দিয়ে গেল। কবিদের বোঝা মুস্কিল, কখন যে কি মুডে থাকে।বুকের উষ্ণতার কথা মনে এল।
ডাক্তার সেনের অ্যাটেনড্যাণ্ট নিরঞ্জন বাবু তক্কে তক্কে ছিলেন বোধহয়, চেম্বার অতিক্রম করতে যাব এসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এই রাস্তা দিয়ে যাও না আজকাল?
–মাঝে মাঝে যাই,কেন?
–একবার উপর থেকে ঘুরে যাও।
–আরেক দিন যাবো।আজ দেরী হয়ে গেছে।
–গরীবকে কেন বিপদে ফেলবে? দেখা দিয়েই চলে যেও।
–এর মধ্যে বিপদের কি আছে?বলছি তো আরেকদিন যাব।
–মালিকের মেয়ে বলে কথা–কদিন ধরে বলেছে–।
নিরঞ্জন বাবু মানুষটা খারাপ নয়।এতকরে বলছেন বয়স্ক মানুষ।উপরে উঠে গেলাম। বসার ঘরে কেউ নেই। আমি ঢুকতে মিসেস সেন এলেন বললেন,অনেকদিন পরে এলে।কেমন আছো?
–ভালই।আপনি?
–ওই একরকম। দিয়া তোমার খোজ করছিল।তোমার মোবাইল নেই?
–বেকার ছেলে মোবাইল দিয়ে কি করবো?ও কলেজ থেকে ফিরেছে?
–পরীক্ষা হয়ে গেছে এখন তো কলেজ যাচ্ছেনা।
জানতাম না দময়ন্তীর ডাকনাম দিয়া। দিয়া মানে কি প্রদীপ? মিসেস সেন চলে যাবার আগে বললেন,তুমি বোসো।
দময়ন্তীর পরীক্ষা হয়ে গেছে? কোনো খবরই রাখিনা। দময়ন্তী ঘরে ঢুকল,পরনে বারমুডা গায়ে ছোট জামা। আরও বাচ্চা লাগছে দেখতে।ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখ।ঝগড়াঝাঁটি করেছে নাকি?ওকে দেখলেই সঙ্কুচিত বোধ করি, কখন কি বলে তার ঠিক নেই।সব সময় গোমড়া মুখো।ওকে একদিন একটা হাসির সিনেমা দেখতে বলবো।
সোফার উলটো দিকে বসে বলল, আজকাল নাকি কাব্যচর্চা শুরু করেছো?
–তা পারলে তো নিজের একটা পরিচয় হতো।
–কথার যাদুতে আমাকে ভোলাতে পারবেনা। অনুরাধা বসুর সঙ্গে মাজদিয়া যাও নি? তোমার চেয়ে কত বড় জানো?
–বড় তো কি হয়েছে?
–ন্যাকামি করবে না।যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে তোমার।
— তুমি কি যা-তা বলছো? অনুদি আমাকে স্নেহ করে,শুনলে কি ভাববে বল তো?
–ভাবলো তো বয়ে গেল! আমি কাউকে ভয় পাইনা।
–উরই বাবাঃ দিয়া জ্বলে উঠেছে–।মজা করার লোভ সামলাতে পারিনা।
ভ্রু কুচকে আমাকে দেখে বলে, দিয়া? এ নাম কি করে জানলে?আমি তো তোমায় বলিনি?
–তোমার আপত্তি আছে? তাহলে বলবো না।
–না আপত্তি নেই কিন্তু সবার সামনে বলবে না। শোনো বেশি চালাকি করবে না,আমাকে তুমি ফাকি দিতে পারবে না জেনে রেখো।
–তোমাকে কেন,আমি কাউকে ফাকি দিতে চাইনা। আচ্ছা তুমি বলো আমি কি তোমার সঙ্গে কখনো বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি?
–তোমাকে বিশ্বাস করিনা তুমি কি বিশ্বাস ভঙ্গ করবে?দেখি তোমার হাতে ওটা কি বই?
বইটা নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করে,সন্দীপ মজুমদার কে?
–আমি কি করে বলবো?
–কবি অনুরাধা বসু বইটা তোমাকে দেয়নি, জনৈক সন্দীপবাবুকে দিয়েছে? তাকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তোমার?
বুঝলাম ক্ষেপে আছে,সব কথার সব সময় গুরুত্ব দিতে নেই।সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে দেখি ডাক্তার সেন ঢুকছেন।যাক বাঁচা গেল আপাতত জেরা হতে মুক্তি!আমাকে দেখে ডাক্তার সেন ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করেন,তোমাকে আগে কোথায় দেখেছি? কেমন চেনা লাগছে মুখটা।
–অনেকদিন আগে বাবাকে নিয়ে চেম্বারে এসেছিলাম–।
–ওঃ হ্যাঁ মনে পড়েছে,তোমার এক দাদা বিদেশে থাকে–।তা তুমি কি করো?
–বছর দুই আগে গ্রাজুয়েশন করেছি।
–এখন তাহলে পোষ্ট গ্রাজুয়েশন?
–আজ্ঞে না।এখন কিছু করিনা।
–মানে বেকার? চাকরির চেষ্টা করতে পারো।বেকার বসে বাবার ঘাড়ে–স্যরি তোমার তো আবার বাবা নেই।আচ্ছা তোমরা কি–অন্তত রাস্তার ধারে একটা জায়গা নিয়ে দোকান দিতে পারো? দেখো ভাগ্য কোথায় নিয়ে ফেলে–ভাগাড়ে না রাজপ্রাসাদে?
অসমাপ্ত ……..