হাসপাতালের করিডোরে মনীষা ও রবি অপেক্ষা করছিলো , অরুণের বায়োপসি রিপোর্ট আসার। মনীষা নিজের ছোট্ট মেয়েটি কে কোলে নিয়ে বসেছিল। রবি অরুণের ছোটবেলার বন্ধু। সবকাজে সবসময় এক আদর্শ বন্ধু হিসেবে পাশে থেকেছে। মনীষা কে বাড়ি থেকে পালাতেও সাহায্য করেছে , এবং দাঁড়িয়ে থেকে মনীষা ও অরুণের চার হাত এক করেছে।
বায়োপসি রিপোর্টে ধরা পড়লো অরুণের মারণ রোগ ক্যান্সার , তাও আবার অ্যাডভান্স স্টেজ। হাতে আর বেশি সময় নেই। শুনেই মনীষা ভেঙে পড়েছিলো। রবি ওকে শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলো কিন্তু তারও মনের অবস্থা ভালো ছিলোনা। বন্ধুর এরূপ অবস্থা সেও সহ্য করতে পারছিলোনা।
অরুণকে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। যতোদিন আছে ততোদিন যত্ন নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। মনে পাথর রেখে মনীষা নিজের সবটুকু উজাড় করে দিলো নিজের স্বামীকে। অরুণের প্রাইভেট জব ছিল। জীবনের আগে প্রথমে তার চাকরি গেলো। দিন দিন তার অবস্থা সবদিক দিয়ে শোচনীয় হয়েগেলো। চিকিৎসার খরচা , ছোট্ট মেয়েটির ভবিষ্যৎ , সবমিলিয়ে এক অভাবের সংসার। কিন্তু এই দুঃসময়ে একমাত্র তার প্রিয় বন্ধু রবিই নিঃস্বার্থ ভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। অর্থনৈতিক সাহায্য থেকে নৈতিক সাহায্য সবই রবির কাছ থেকে তারা পেতো। একজন আদর্শ পারিবারিক বন্ধু যেরকম হয় আর কি।
দিন দিন অরুণের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকলো। সে এবার ঠিক মতো উঠতে চড়তে পারছিলোনা। নিজের উপর ধিক্কার দিচ্ছিলো তার এই করুণ অবস্থার জন্য। বারবার নিজেকে সংসারের একটা বোঝা হিসেবে মনে হতে লাগলো। সে এখন একা একা বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারেনা। তার জন্যও তাকে বউয়ের সাহায্য নিতে হয়। সে জানে তার হাতে বেশি সময় নেই। তাই সে বারংবার নিজের মৃত্যুকামনাই করে। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ঢের ভালো। কিন্তু মনীষা ? ওর কি হবে ? তাছাড়া ওদের মেয়ে পরীরও বা কি হবে ? ওদের কি ভবিষ্যৎ অরুণের চলে যাওয়ার পর ? এই কথাগুলো অরুণকে সবসময়ে চিন্তায় রাখতো।
রবি প্রায় আসতো তাদের বাড়ি। ওদের খোঁজখবর নিতে এবং আর্থিক সাহায্য করতে। যখুনি অরুণের ডাক্তারের অ্যাপয়ন্টমেন্ট থাকতো , রবি যেত ওর সাথে। সবসময়ে মনীষা যেতে পারতোনা মেয়েটার জন্য। রবি ও মনীষার মধ্যে প্রায় কথা হতো , ফোনে ও সামনাসামনি। এবং বেশিরভাগটাই হতো অরুণকে নিয়েই। অরুণের চিকিৎসা , খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি নিয়ে। অরুণ লক্ষ্য করতো যে ওর পর যদি কেউ মনীষার এতো যত্ন নেয় সেটা আর কেউ নয় তার বন্ধু রবি। সে একদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো অনেকক্ষণ। এবার অরুণ একটা চরম সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের পরিবারের জন্য , নিজের মেয়ের জন্য , সর্বোপরি মনীষার জন্য।
সে একদিন রবি কে ডাকলো , কিছু জরুরি কথা বলার জন্য।
“বল অরুণ , কি বলবি। ….”
“রবি , তুই তো সবই জানিস। আমি আর বেশিদিন নেই। ”
“প্লিজ , এইভাবে বলিসনা। তুই ঠিক হয়ে যাবি , বিশ্বাস কর। ..”
“কেন মিথ্যে আশা দিচ্ছিস ভাই। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড , তোর মুখে এরকম ফর্মাল কথা মানায় না। আমি আমার ভবিতব্য মেনে নিয়েছি। ..”
“আচ্ছা তবে বল , কি বলতে চাইছিস। ..”
“আমি ভাবছি যে আমি চলে যাওয়ার পর মনীষা ও পরীর কি হবে ? আমার চাকরি নেই , পেনশন নেই , ইন্সুরেন্স করাও নেই। কি করে জানবো বল যে এতো তাড়াতাড়ি মৃত্যু কড়া নাড়বে দরজায়। আমি যাওয়ার পর কি ওরা না খেতে পেয়ে মরবে? আগে জানলে তো পরীকে এই পৃথিবীতেই আনতাম না ” , এই বলে অরুণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
রবি ওকে শান্ত্বনা দিতে দিতে বললো , “কাঁদিস না ভাই। আমি তো আছি। ..”
“তাই জন্যই তো আজ তোকে ডেকেছি। আমার একটা আর্জি আছে। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখেছি। ……”
“মানে ?? কি আর্জি ??”
“আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে…. মনীষাকে তোর কেমন লাগে ?”
“ভালোই। .. তুই খুব লাকি , মনীষার মতো একজন স্ত্রীকে পেয়ে। ”
“বাদ দে। আমি কতো লাকি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছিস , আমার অবস্থা দেখে। কিন্তু তুই সেই লাকি ব্যক্তি হতে পারিস। ”
“ঠিক কি বলতে চাইছিস তুই ?”
“তুই মনীষাকে বিয়ে কর। ”
“কি !! তুই কি পাগল হয়েছিস !! তোর মাথার ঠিক আছে। আগে মনে হয় তোর মাথার চিকিৎসা করার দরকার “, রবি হকচকিয়ে বলে উঠলো। সে যে তখনও পর্যন্ত মনীষাকে অন্য চোখে দেখেনি।
“শান্ত হ রবি। আমি যা বলছি খুব ভেবেচিন্তেই বলছি। দেখ , তুই এখনো বিয়ে করিসনি। চাকরি করিস , এস্ট্যাব্লিশড। আর মনীষা মেয়ে হিসেবেও তো খারাপ নয়। দেখে কেউ বলবে ওর একটা ছোট্ট মেয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দরী। তুই তো একবার বলেছিলিস না যে ওকে দেখতে একেবারে ঈশা সাহার মতো।”
“দেখ লজিক্যালি তুই যা বলছিস তা হয়তো ঠিক। তুই চলে যাওয়ার পর ওর এবং পরীর একজন সাথী দরকার। কিন্তু তা বলে আমি কি করে। ……”
“ওহঃ বুঝেছি। আসলে কি বলতো , ক্ষুদিরাম সবসময়ে পাশের বাড়ি থেকে হলেই আমাদের ভালো লাগে। আমরা লোক কে মহান দেখতে চাই , কিন্তু নিজে মহান হতে পারিনা। কারণ তার জন্য লাগে অনেক বড়ো স্যাক্রিফাইস। তুই জানিস আমি আর কিছুদিনের মধ্যে মারা যাবো। আমি চলে যাওয়ার পর আমার বউ বাচ্চা কে দেখার কেউ থাকবে না। আমার এখন কোনো চাকরিও নেই , যে সেটা পরে মনীষা পাবে , বা ও কোনো পেনশন ভাতা পাবে। আমি চলে যাওয়ার পর মনীষা অর্ধনৈতিক , মানসিক , শারীরিক সবদিক দিয়ে একা হয়ে পড়বে। তোকে ছাড়া আমি আর কাকেই বা বিশ্বাস করি বল। তুই একমাত্র ওর অবলম্বন হতে পারিস।”
“কিন্তু আমি কখনো মনীষা কে ওই চোখে দেখিনি। আর না মনীষা কখনো আমাকে সেই চোখে দেখেছে। ”
“এবার দেখ। অন্তত মনীষা ও আমার মেয়েটার স্বার্থে। আমি জানি তুই সিঙ্গেল। আর মনীষার বিয়ে নাহলে সেও তোর জন্য একদম পারফেক্ট মেয়ে ছিল।”
“কিন্তু। …….”
“আর কোনো কিন্তু নয় ভাই। তুই মনীষা কে আপন করে নে প্লিজ। তাহলে আমি একটু শান্তিতে মরতে পারবো। ”
“মনীষা আমার হয়ে গেলে তুই সহ্য করতে পারবি ?”
আলবাত পারবো। আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হবেনা তখন। আমি মনীষাকে সেট্লড করে যেতে চাই। আমার মেয়ের ফিউচার সিকিউর করে যেতে চাই। আর সেটা তখুনি সম্ভব যখন তুই মনীষার হাতটা ধরবি। ”
“মনীষা জানে তোর এই পাগলামোর কথা ?”
“ওকে এখনও বলিনি। আগে তুই রাজি হও , তারপর আমি ওকে ঠিক রাজি করিয়ে নেবো। ও আমার কথা ফেলেনা। এটাও ফেলবেনা , রাখবে।”
“দেখ তুই যা বলছিস তা সত্যি আমার খুব অদ্ভুত লাগছে। কিরকম যেন একটা মনে হচ্ছে। আমাকে একটু সময় দেয় , ভাববার জন্য। তুইও ভাব , যেটা তুই করতে চলেছিস সেটা উচিত হবে কিনা। ”
“আমার আর কিছু ভাবার নেই। আমি ভেবেচিন্তেই কথাটা বলেছি। এবার সিদ্ধান্ত তোর। তুই তোর বন্ধুর পরিবারটা কে বাঁচাতে চাস কিনা। তুই সময় নিতে চাইছিস , নে সময়। কিন্তু দেখিস , বেশি সময় নিস না। আমার হাতে কিন্তু সময় খুব কম। আমি তোদের ঘর সংসার গুছিয়ে দিয়ে যেতে চাই। ”
রবি চিন্তাভরা মুখ নিয়ে চলে গেলো। বেশ কয়েকদিন রবি এলোনা। তারপর একদিন অরুণের ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট ছিল। মনীষার সাথে রবিও গেলো অরুণ কে নিয়ে হাসপাতালে। সেইসময়ে রবি আড় চোখে মনীষার দিকে তাকাতে থাকলো। মনীষা কে যেন সে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে লাগলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো যদি সত্যি নিজের বন্ধু অরুণের বউকে বিয়ে করতেই হয় তবে কেমন হবে ব্যাপারটা। নো ডাউট মনীষা এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের ভান্ডার ছিল। যেকোনো পুরুষের মন ওর জন্য বিচলিত হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু রবি এতোদিন ওকে সেই চোখে দেখেনি। এখন দেখতে শুরু করেছে। মনে মনে সুপ্ত বাসনা এবার রবির মনে জাগতে শুরু করেছে নিজের বন্ধুর স্ত্রী কে নিয়ে।
রবির নজর বারবার অকারণে মনীষার দিকে যাচ্ছিলো। মনীষা নোটিস না করলেও অরুণ সেটা করলো। অরুণ বুঝলো যে রবি মনে মনে তার প্রোপোজাল টা একসেপ্ট করেছে। কিন্তু তাও কেন অরুণের খারাপ লাগছিলো মনীষার দিকে রবির অকারণ চেয়ে থাকা দেখে ? আসলে সে তো মন থেকে চাইনি নিজের স্ত্রী কে অন্যের হাতে তুলে দিতে। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করছে। সে তার স্ত্রী কে ভালোবাসে। তাই চায় মনীষার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করার পর থেকে মনীষার বাড়ির সাথে সম্পর্ক পুরোপুরিভাবে ছিন্ন। অরুণেরও একুল ওকূলে সেরকম কেউ নেই। আত্মীয়স্বজন কেউ সুজন নয়। তাহলে তার মৃত্যুর পর মনীষা যাবে কোথায় ? তাই তো মনে পাথর চেপে অরুণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনীষা কে রবির হাতে তুলে দিতে।
বাড়ি ফিরে অরুণ রবিকে জিজ্ঞেস করলো ওর সিদ্ধান্তের কথা। রবি মাথা নিচু করে অরুণের প্রস্তাবে সম্মতি দিলো। অরুণের বুকটা কেন জানি ছ্যাৎ করে উঠলো। সব দুঃখ কষ্ট চেপে অরুণ রবিকে নির্দেশ দিলো যাতে সে যেন মনীষার কাছাকাছি থাকার এবং যাওয়ার চেষ্টা করে। রবি বারবার নিজের প্রিয়বন্ধু কে জিজ্ঞেস করলো , সে সত্যি এসব চায় কিনা। অরুণও বারবার দাঁত চেপে প্রকাশ করলো নিজের সম্মতির কথা। অবশেষে রবি অরুণের কথা মেনে নিলো। তবে সে বললো মনিষা কে এই ব্যাপারে কথা অরুণ কেই বলতে হবে। অরুণ রাজি হয়েগেলো। তবে একটু সময় চেয়ে নিলো। আর এই সময়ের মধ্যে অরুণ চাইলো রবি যেন মনীষা কে একটু বেশি সময় দ্যায় , বন্ধু হিসেবেই।
দুই বন্ধুর মধ্যে কথা ফাইনাল হলো। তারপর কয়েকদিন রবি রোজ অরুণের বাড়ি আসতে লাগলো। মনীষার ঘরোয়া কাজে সাহায্য করতে লাগলো। মনীষা ব্যাপারটা কে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ হিসেবেই দেখলো। কারণ রবি প্রথম থেকেই খুব হেল্পফুল। ওই তো অরুণ ও মনীষাকে সাহায্য করেছিল পালিয়ে বিয়ে করতে। ও না থাকলে অরুণ এবং মনীষার বিয়েটাই হতোনা। যাই হোক অবশেষে সেই দিনটা এলো যেদিন অরুণ মনীষাকে নিজের কথা খুলে বললো।
“মনীষা। …..”
“হ্যাঁ বলো। ..”
“তুমি আমাকে ভালোবাসো ?”
“এটা কোনো কথার কথা হলো ? তোমার কোনো সন্দেহ আছে ?”
“আহঃ , তাও বলোনা। ভালোবাসো আমায় ?”
“হ্যাঁ। সবথেকে বেশি এবং শুধু তোমায় ?”
“তাহলে আমার কথা সব রাখবে ?”
“বলো। ..”
“তুমি তো জানো মনীষা আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। প্লিজ , শান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করোনা , আমি বাচ্চা নই। সত্যিটা কে একসেপ্ট করতে জানি। এবং তুমিও সেটা একসেপ্ট করো। ”
“তুমি বলতে কি চাইছো ?”
“আমার একটা শেষ ইচ্ছে রয়েছে। সেটা তুমি রাখবে ?”
“কি বলো ?”
“তুমি আবার নিজের জীবনটা কে নতুন করে শুরু করো। ”
“মানে ?”
“তুমি বিয়ে করো। ”
“তুমি কি পাগল হয়েছো ?”, মনীষা চিৎকার করে উঠলো।
শান্ত গলায় অরুণ বললো , “শান্ত হও মনীষা। কালম ডাউন। নিজের কথা না ভাবো , অন্তত আমাদের পরীটার কথা ভাবো। আমার কি আছে যা রেখে যাবো তোমাদের জন্য। তোমরা তো পথে বসবে। আমি তো তাহলে মরেও শান্তি পাবোনা। ”
মনীষা কাঁদতে কাঁদতে বললো , “প্লিজ অরুণ , তুমি চুপ করো। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইছি না। ”
এই বলে মনীষা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। অরুণ বুঝলো এইভাবে মনীষা কে কনভিন্স করানো যাবেনা। অন্য পথ দেখতে হবে। অরুণ তাই খাওয়া-দাওয়া ওষুধ নেওয়া বন্ধ করে দিলো। মনীষা জিজ্ঞেস করলো কেন অরুণ এরকম করছে। এরকম করলে তো ও আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। জবাবে অরুণ বললো সে তাড়াতাড়ি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায়। কারণ সে দাঁড়িয়ে থেকে তার পরিবারের দুর্গতি আর দেখতে পারবে না। তার স্ত্রী যখন ঠিকই করে নিয়েছে তার মৃত্যুর পর নিজের ও মেয়ের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দেবে তখন তার আশাহত হয়ে দ্রুত মরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মনীষা বুঝতে পারলো অরুণ কেন এরূপ ব্যবহার করছে। সে তার স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে সে তার স্বামী ব্যাতিত আর কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে পারবে না। অরুণও উল্টে তাকে বাস্তব পরিস্থিতির সাথে অবগত করানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
“আচ্ছা , ধরো মেনেও নিলাম তোমার কথা। কিন্তু এমন কাউকে কোথায় পাবো যে আমাকে তোমার মতো করে ভালোবাসবে? ”
“পাবে , নিশ্চই পাবে। ”
“তা আমার হাসবেন্ড আমার জন্য নতুন বর খুঁজে দেবে ? কোথা থেকে পাবে শুনি ?”
“আর যদি বলি , খোঁজা হয়েগেছে। ”
“মানে , কি বলতে চাইছো তুমি ?”, মনীষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“আগে বলো , তুমি রিএক্ট করবে না। শান্ত হয়ে সবকথা শুনবে। ”
“ঠিক আছে , বলো। ”
“রবি কে তোমার কেমন লাগে ?”
“কি !! তুমি রবি কে। …..”
“আগেই বলেছি , রিএক্ট করোনা। ”
“রবি এসব জানে ? তুমি কিসব ভাবনা ওকে নিয়ে মাথায় চাষ করছো। ..”
“দেখো , তুমি আমাকে খারাপ ভাবো , ভুল বোঝো , তবুও আমি বলবো আমি যা বলছি খুব ভেবেচিন্তে বলছি। মনীষা তুমি কেন বুঝতে পারছো না , আমি চলে যাওয়ার পর ইউ নিড সামওয়ান। আর আমি রবি ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। রবিই একমাত্র তোমার আর আমাদের মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারে। তাই তোমাকে রবির হাতে তুলে দিলে আমি অন্তত শান্তিতে মরতে পারবো। এইটুকু তো তুমি করতেই পারো। আমার জন্য আমাদের পরিবারের জন্য। ”
“কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব। আমি রবির সম্পর্কে এসব কখনো কল্পনাও করিনি। ”
“এখন করো , এখন ভাবো। রবি শুধু আমার বন্ধু নয় , এখন ও তোমারও একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। আর একজন ভালো বন্ধুকে যদি তুমি বাকিটা জীবন সঙ্গী হিসেবে পাও , তাহলে দেখো , তুমিও ভালো থাকবে আর সেও। ”
“এসব কথা ভাবার আগে তুমি একবারও রবির সাথে কথা বলেছো ? মানছি তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ দিয়ে দেখতে হলে তুমিই হয়তো ঠিক। কিন্তু তুমি কি করে কাউকে না জানিয়ে তার মতামত না নিয়ে তার জীবন সম্পর্কে এতো বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে পারো ? আমার সম্পর্কে তুমিই বলতেই পারো এসব কথা , কারণ আমি তোমার স্ত্রী। আমার জীবন এবং আমার জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তোমার সম্পূর্ণ ভাবে আছে। কিন্তু রবি ? ওর উপর তুমি কিছু চাপিয়ে দিতে পারোনা। তাছাড়া আমি কারোর জীবনে বোঝা হতে পারবো না। ”
“আর যদি বলি রবি রাজি আছে। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ”
“কি !!!!……”, মনীষা আকাশ থেকে পড়লো অরুণের এই কথা শুনে।
“আমি ঠিকই বলছি মনীষা। আমি রবিকে রাজি করিয়ে নিয়েছি। সে প্রস্তুত তোমার আর পরীর দায়িত্ব নিতে। এবার তোমার পালা। তুমি যদি রাজি থাকো এই সম্পর্কে তাহলে আমি জীবনের বাকিটা সময়ে শান্তিতে কাটাতে পারবো , এবং নিশ্চিন্তে মরতে পারবো। যদি সেটা তুমি চাও। আর নইলে , আমাকে বুকভরা কষ্ট , ও হাজারো চিন্তা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে। মরেও শান্তি পাবনা। এবার তুমি বলো , কি চাও ? আমাকে একটু শান্তি দিতে নাকি নিজের স্ত্রী ধর্ম পালনের নামে আমাকে এক কষ্টকর মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে ?”
অরুণের কথা শুনে মনীষা বসে পড়লো। সে বুঝতে পারছে না , সে কি করবে। স্ত্রী ধর্ম পালন করবে নাকি স্বামীর ইচ্ছের মর্যাদা রাখবে ? সেদিন মনীষার আর কোনো কাজে মন লাগলো না। রাতে ঠিকমতো ঘুমোতেও পারলো না। দু’দিন এভাবে কেটে গেলো। অবশেষে মনীষা হেরে গেলো , অরুণের ইচ্ছাশক্তির কাছে। তার কাছে যে আর অন্য কোনো পথ খোলা ছিলোনা। জীবন তাকে এমনই একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো। সে অরুণকে গিয়ে বললো যে সে রাজি , এবং জানতে চাইলো তাকে কি করতে হবে , তার স্বামীর ইচ্ছে রাখার জন্য।
“সবার প্রথমে তুমি আমাকে ডিভোর্স দাও। ”
“কি !!”
“হ্যাঁ , ঠিকই শুনলে। সবার আগে আমাদের ডিভোর্স হবে। তারপর আমি দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের চার হাত এক করবো। ঠিক যেভাবে রবি আমাদের বিয়ে দিয়েছিলো মন্দিরে নিয়ে গিয়ে। এবার আমার জায়গায় থাকবে রবি , আর রবির জায়গায় আমি। তারপর রবি এই বাড়িতে এসেই থাকবে, যতোদিন আমি রয়েছি। আমি পরীকে নিয়ে অন্য ঘরে শিফট করে যাবো। আর তুমি ও রবি একই রুমে থাকবে স্বামী-স্ত্রীর মতো। ”
“অসম্ভব ! আমি এটা কিছুতেই করতে পারবো না। ”
“তোমাকে করতেই হবে। আমার জন্য না হোক , নিজের জন্য না হোক , আমাদের মেয়ের জন্য তোমাকে এই পদক্ষেপ নিতে হবে , নিতেই হবে। ”
মনীষা অনর্গল কাঁদতে লাগলো। তার কান্না যেন থামার নামই নিচ্ছিলো না। অরুণের মন অনেকটাই ভারাক্রান্ত ছিল। তবুও সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলো মনীষা কে শান্ত্বনা দিয়ে বোঝানোর। মনীষার কাছে আর অন্য কোনো রাস্তা পড়েছিলোনা , নিজের স্বামীর কথায় রাজি হওয়া ছাড়া। অবশেষে একদিন অরুণ রবি কে ডাকলো। মনীষার সামনেই রবিকে তার সব পরিকল্পনা বুঝিয়ে বললো। রবি ফের একবার অরুণ কে বললো তার সিদ্ধান্তটা পর্যালোচনা করে দেখতে। অরুণও বললো সে অলরেডি ভেবে নিয়েছে। সে জানে তার আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই , কিন্তু তার স্ত্রী ও মেয়ের আছে। তাদের ভবিষ্যৎ টা তাকেই সুরক্ষিত করে রেখে যেতে হবে।
কথামতো অরুণ ও মনীষার ডিভোর্স হয়ে গেলো। এটা পৃথিবীর প্রথম ডিভোর্স যেখানে স্বামী স্ত্রী অনিচ্ছাকৃত সত্ত্বেও শুধুমাত্র সিচুয়েশনের কবলে পড়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে বাধ্য হলো। ঠিক হলো তাদের মেয়ের কাস্টডি মা-ই পাবে , খুব স্বাভাবিক ভাবে। কয়েকদিন পর অরুণ মন্দিরে নিয়ে গিয়ে রবি ও মনীষার বিয়ে দিয়ে দিলো। তাদের রেজিস্ট্রি ম্যারেজও করালো।
সেদিন ছিল রবি ও মনীষার বিয়ের পরের প্রথম রাত। রবি অরুণের বাড়িতে শিফট হয়েগেছিলো। মনীষা কাঁদতে কাঁদতে অরুণের কাছে জিজ্ঞাসা করলো যে সে কি করে একই ছাদের তলায় তার ও রবির সাথে থাকবে ? বিশেষ করে রবির সাথে , যেখানে পাশের ঘরেই তার প্রাক্তন কিন্ত প্রকৃত স্বামী অরুণ থাকবে। অরুণ ওকে বোঝালো মহাভারতের উদাহরণ দিয়ে , যে দ্রৌপদীরও পাঁচ স্বামী ছিল, এবং প্রত্যেকের সহিত তার সন্তান হয়েছিলো। সন্তান হওয়ার কথা শুনে মনীষা চমকে গেলো। সে অরুণের কাছ থেকে এরূপ উদাহরণ দেওয়ার অন্তর্নিহিত অর্থ জানতে চাইলো।
অরুণ বললো সে তাকে বোঝাতে চাইছে যে মহাভারত কাল থেকে নারী চাইলে একই সাথে একাধিক স্বামীর সহিত সহবাস করতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে যেটা হয় পলিগ্যামি , মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা পলিএন্ড্রি। আর সন্তান হওয়ার কথাতে তুমি এতো বিচলিত কেন হলে ? আজকে রবি আমার সংসারটা কে বাঁচাতে তোমাকে বিয়ে করেছে। কাল রবির স্বামী হিসেবে নিজস্ব কিছু চাহিদা থাকতেই পারে। তোমার তখন উচিত হবে নিজের স্ত্রীর ধর্ম পালন করা, রবির স্ত্রী হিসেবে।
মনীষা অবাক পানে চেয়ে অরুণ কে জিজ্ঞেস করলো , “তুমি কি করে পারছো এসব করতে ? কি করে পারছো এতোটা কঠিন হতে ?”
“আমি এখন সব পারা আর না পারার উর্ধে উঠে গেছি। ভাগ্য আমাকে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন করিয়েছে , সেখান থেকে দাঁড়িয়ে আমি এখন আর আমার কথা ভাবছিনা। ভাবছি তোমার কথা , আমাদের সন্তানের কথা। আর আমার মনে হয় , তোমারও সেটাই করা উচিত। আমি এখন ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতায় প্রবেশ করছি। ”
অরুণের কথা শুনে মনীষা কাঁদতে কাঁদতে অরুণকে জড়িয়ে ধরলো। অরুণ বললো সে এখন তার কাছে পরপুরুষ। তাই নিজের স্বামী থাকতে মনীষার মতো রুচিশীল মেয়ের এরূপ অন্য পুরুষের সহিত আলিঙ্গনে লিপ্ত হওয়া শোভা পায়না। অরুণ নিজের মনের জোড় রেখে মনীষা কে ধীরে ধীরে রবির দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। তাই বারংবার মনীষাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলো যে এখন তার স্বামী রবি , সে নয়।
মনীষা নিজের ঘরে বসেছিল। অরুণ মেয়ে কে নিয়ে পাশের ঘরে শিফট হয়ে গেছিলো। কিচ্ছুক্ষণ পর রবি মনীষার বেডরুমে প্রবেশ করলো। রবি কে দেখে মনীষার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। দুজনের মধ্যে বেশ কিচ্ছুক্ষণ কোনো কথা হলো না।