মনীষা নিজের ঘরে বসেছিল। অরুণ মেয়ে কে নিয়ে পাশের ঘরে শিফট হয়ে গেছিলো। কিচ্ছুক্ষণ পর রবি মনীষার বেডরুমে প্রবেশ করলো। রবি কে দেখে মনীষার মনে এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। দুজনের মধ্যে বেশ কিচ্ছুক্ষণ কোনো কথা হলো না।
তারপর মনীষা নিজেই রবিকে বললো , “দেখো রবি , তুমি আমাদের অনেক সাহায্য করেছো। তার জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু তোমার নববিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে তুমি আমার কাছ থেকে কিছু আশা করোনা প্লিজ। তোমাকে তাহলে বারংবার আশাহত হতে হবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কি পরিস্থিতিতে এই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছি। ”
“আমি বুঝি মনীষা। তুমি চিন্তা করোনা , আমি কখনো তোমার অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার চেষ্টা করবো না। তুমি আমার কাছে এখনো অরুণের স্ত্রী হিসেবেই যথাযত সম্মান পাবে। ”
কিচ্ছুক্ষণ পর রবি আবার বলে উঠলো , “আমি কিন্তু ইচ্ছে করে বিয়েটা করতে চাইনি। তুমি চাইলে অরুণের সাথে থাকতে পারো। ”
“অরুণ নিজেই আমার সাথে থাকতে চায়না। সে আমাকে পর করে দিয়েছে এখন “, খুব দুঃখে ও অভিমানের সাথে মনীষা কথাটি বললো।
“অরুণ যা করেছে তোমার আর পরীর ভালোর কথা ভেবে করেছে। ”
“আমি তো এতোটা ভালো চাইনি। ”
রবি আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না। সে আর কথা না বাড়িয়ে মনীষাকে বিছানার এক ধারে শুয়ে পড়তে বললো। রবিও একই বিছানায় শুলো কিন্তু মনীষার সাথে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে।
এভাবে কিছুদিন কেটে গেলো। মনীষা নিজের স্বপ্নেতেও রবিকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলো না। রবিও নিজের সীমা লংঘন করার সাহস দেখায়নি। অরুণ বুঝতে পারছিলো যে রবি ও মনীষার বিয়ে হলেও তারা এখনও পরস্পরের প্রতি দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে, বিশেষ করে মনীষা। কিন্তু এভাবে চললে তো তারা সারাজীবনেও এক হবে না। অরুণকে তো নিজের মৃত্যুর আগে সবকিছু ঠিক করে দিয়ে যেতে হবে। তাই সে রবির সাথে এই নিয়ে কথা বলবে বলে ঠিক করলো। রবির সাথে সে একান্তে একদিন বসলো।
– “দেখ রবি , তোকে একটা সহজ কথা জিজ্ঞেস করছি , তোরা কি আমার কথা ভেবে একে অপরের থেকে দূরে সরে রয়েছিস ?
– “সত্যি বলতে মনীষাই তো এখনও মন থেকে আমাকে মেনে নিতে পারেনি। ও এখনো তোকেই নিজের স্বামী বলে ভাবে, এবং সারাজীবন হয়তো তাই ভাববে।”
– “তুই যদি ওর কাছাকাছি না যাস , ও কখনোই তোকে নিজের মনে জায়গা দেবে না। ”
– “আমি সেটা কি করে করবো ! আর সর্বোপরি তুই আমাকে বলছি নিজের বউয়ের কাছাকাছি যেতে। ”
– “রবি , ও এখন তোর স্ত্রী , আমার নয়। ”
– “সেটা পরিস্থিতির কারণে অরুণ। তুই ওকে বাধ্য করেছিস আমাকে বিয়ে করতে। ”
– “আমার কাছে যে অন্য কোনো রাস্তা খোলা ছিলোনা। ”
– “জানি ভাই , তাই জন্যই তো তোকে সম্পূর্ণ দোষ দিতে পারছিনা। দোষটা আমাদের কপালের। ”
– “এভাবে হাল ছেড়ে দিলে তো হবেনা ভাই। আমার নয় জীবনটা প্রায় শেষের দিকে , কিন্তু তোদের তো জীবন এখনো অনেকটা পড়ে রয়েছে। আর আমার বাচ্চাটার কি হবে ? জানি তুই ওর নতুন বাবা হিসেবে সব দায়িত্ব নিবি , কিন্তু ওর মা কে সবসময়ে এরকম উদাস মনে মনমরা হয়ে ঘুরতে দেখলে ওরও মনে তার ঋনাত্মক প্রভাব পড়বে। ”
– “তাহলে তুই আমাকে কি করতে বলছিস বল। ”
এবার আরো একবার বুকে পাথর রেখে অরুণ জবাব দিলো , “তুই আজকে রাতে ওর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা কর। ”
– “অরুণ , তুই এই কথাটা বলতে পারলি ! মনীষা তোকে কতো ভালোবাসে। যতোই আমাদের নাম কে ওয়াস্তে বিয়ে হয়ে যাক , ও এখনো শুধু তোকেই ভালোবাসে। আমি ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কি করে এসব করবো !”
– “ওকে আমিও যে খুব ভালোবাসি। আর ভালোবাসি বলেই তো ওর ভালো চাই। আর তাই তোকে এসব করতে বলছি। যাতে ও নতুনভাবে তোর সাথে জীবনটা শুরু করতে পারে , সেটা মারা যাওয়ার আগে আমি দেখে যেতে চাই। ”
– “কিন্তু ও আমাকে নিজের শরীর স্পর্শ করতে দেবে না। ”
– “তুই একবার চেষ্টা তো কর ওর কাছে যাওয়ার। আমি জানি সাময়িকভাবে বাধা দিলেও পরে ও ঠিক তোকে আপন করে নেবে। শরীরের জ্বালাও তো একটা বড়ো জ্বালা। ও কতোদিন এভাবে উপবাসী হয়ে থাকবে আমার জন্য। কতোদিন হয়ে গ্যাছে ওর সেই সুন্দর কোমল শরীরে কোনো পুরুষের স্পর্শ পড়েনি। এটা তো ওর সৌন্দর্যের প্রতি চরম অন্যায় করা হচ্ছে। কারণ এতোদিন আমিই একমাত্র পূজারী ছিলাম এই সৌন্দর্য্যের। যে সুন্দর শরীরকে প্রতি রাতে আমার পুজো করা উচিত , তাকে আমি হেলায় ফেলে রেখেছি , নিজের শারীরিক অসুস্থতার দোহায়। এখন তুই সেই পূজারী হয়ে ওঠ রবি। তুই ওর ভবিষ্যৎ , আমি ধীরে ধীরে বাস্তব থেকে ওর স্মৃতিতে প্রবেশ করে যাবো। ”
অরুণের কথাগুলো শুনে রবির রোম খাঁড়া হয়ে গেলো। অরুণ যৌনতাকে কি সুন্দরভাবে বর্ণনা করতে পারে , সত্যিই ! মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ যখন জানতে পারে তার মৃত্যু আসন্ন , তখন হয়তো সে আপনা-আপনি কবি ও দার্শনিক হয়ে ওঠে। কারণ সে ততোদিনে সব জাগতিক মোহ-মায়া কাটিয়ে উঠেছে।
যাই হোক , অরুণের সাথে কথা বলে রবি ডিনার টা সেরে নিলো। অরুণ যথারীতি নিজের ঘরেই ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ডায়েট খাবার খেলো , যা মনীষা রান্না করে অরুণের জন্য নিয়ে এসছিল। রাতে মনীষা নিজের কাজবাজ সেরে ঘরে চলে গেলো ঘুমোতে। পাশের ঘরে অরুণের পাশে তাদের ছোট্ট মেয়ে পরী চুপটি ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ব্যালকনিতে রবি সিগারেটে টান মারছিলো এবং অরুণের বলা প্রতিটি কথাকে recall করছিলো।
সিগারেট শেষ করে রবি এবার মনীষার ঘরের দিকে যেতে লাগলো। অরুণের ঘরের দরজা খোলা ছিল। অরুণ বালিশে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো। তারও যে ঘুম আসছিলোনা আজ। সে যে নিজের বন্ধুকে একপ্রকার লাইসেন্স দিয়ে ফেলেছিলো তার স্ত্রীয়ের উপর শারীরিক অধিকার ফলানোর। আজকেই হয়তো তার মনীষা তার বন্ধুর হয়ে যাবে , চিরকালের জন্য।
সারাজীবনের জন্য সে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলবে। ভেবেই অরুণের বুকটা যেন কষ্টে ফেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে তো এই কঠিন পদক্ষেপটা নিতেই হতো , তার পরিবারের মঙ্গলের জন্য। মনীষা যদি এভাবে রবির থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে , দূরে দূরে পালায় , তাহলে হয়তো একদিন রবি বিরক্ত হয়ে তার বন্ধুর চাপিয়ে দেওয়া সংসারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চাইবে। তখন মনীষা ও পরীর কি হবে ! একটি মেয়ে যখন তার স্বামীকে হারিয়ে ফেলে , এবং সেই মেয়ে যদি অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী ও এক সন্তানের জননী হয় , তখন সেই বিধবা মেয়েটিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কেবল নিজের শিকার ভেবে হিংস্র হায়নার মতো শুধু শোষণ করতে চায় , দায়িত্ব কেউ নিতে চায়না। তাই অরুণের হাতে আর কোনো উপায় ছিলোনা , নিজের স্ত্রীকে নিজের বিশ্বস্ত বন্ধুর হাতে তুলে দেওয়া ছাড়া। রবির কাছে মনীষা ও তার মেয়ে পরী অন্তত সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকবে।
রবি মনীষার ঘরে যাওয়ার আগে একবার অরুণের ঘরের দিকে তাকালো। দেখলো অরুণ চাতক পাখির মতো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। রবি প্রশ্নভরা মুখ করে অরুণের দিকে তাকালো , যেন সে জানতে চাইছে অরুণের সত্যি সম্মতি রয়েছে কিনা। অরুণও চোখের ইশারায় তাকে ঘরে যেতে বললো। সম্মতি দিলো নিজের স্ত্রীকে আপন করে নেওয়ার।