বাংলা চটি সাহিত্য চতুর্থ পর্ব
এটাকে দৃশ্য বলা উচিত হবে কি না জানি না, কারণ দৃশ্যটা আমি চোখে দেখি নি, শুধু কথপোকথন শুনেছি। তাই এটাকে শ্রুতিকথা বলাই বোধ হয় ঠিক হবে।
দিনটা ছিল আজকের মতোই, আর এক চব্বিশে ডিসেম্বর, রবিবার। পাড়ার সবাই মিলে শীতের কোনো এক রবিবারে কাছাকাছি কোথাও পিকনিক করে। সে বছর ঠিক করা হলো চব্বিশে ডিসেম্বর পিকনিক হবে টাউন থেকে ৪৩ কিলোমিটার দুরে মূর্তি-তে। সাধারনত এ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে বাবার যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
রবিবারের দিনগুলো বাবা দলের কাজে বেশী ব্যস্ত থাকেন, বেশীরভাগ রবিবারই তিনি টাউনের বাইরে থাকেন। সেবার কি আশ্চর্য্য, সেই দিনটায় পার্টির কোনো কর্মসূচী ছিল না, বাবা টাউনেই থাকবেন। আরো অবাক করা ব্যাপার, বাবা রাজিও হয়ে গেলেন পিকনিকে যেতে।
শুধু একটা ব্যাপারেই একটু সমস্যা হলো। অন্যান্য বারের মতো এবারেও আমরা লালুমামার গাড়ীতেই যাওয়া ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বাবা বেঁকে বসলেন; তিনি এবং আমরা সবার সাথে ভাড়া করা বাসে যাবো। একটু অসন্তুষ্ট হলেও, মা কোনো অশান্তি না করে, বাবার জেদ মেনে নিলেন।
এখন বুঝতে পারি, বাবা কেন তার স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে ওই বছর পিকনিকে যেতে রাজি হয়েছিলেন। কারণ ওই বছরই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সপ্তমবার তার দলের সরকার গড়লেও, শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিও সম্প্রদায়ের মধ্যে দলের প্রভাব কমছিলো। খোদ আমাদের টাউনেই গতবারের বিজয়ী শরিক দলের নেতা হেরেছিলেন।
পাশে দিনহাটাতেও শরিক দলের জেতা আসন ছিনিয়ে নিয়েছিলো বিরোধী দল। ফলে পার্টির অন্দরমহলে নড়াচড়া শুরু হয়েছিলো। দলের সব স্তরের কর্মীদের উপর নির্দেশ এসেছিলো গণসংযোগ বাড়ানোর জন্য। শুধুই পার্টি অফিস এবং পার্টি কর্মী-সমর্থকদর সঙ্গে না মিশে, মেলামেশার গন্ডীটা বাড়াতে হবে।
সাধারন মানুষের সাথে মিশতে হবে, তাদের অভাব-অভিযোগ শুনতে হবে, তাদের সমালোচনা মাথা পেতে নিতে হবে। স্থানীয় স্তরে যে অরাজনৈতিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, সেগুলিতে অংশগ্রহন করতে হবে। পার্টি অন্তঃপ্রাণ বাবার পক্ষে পার্টির এই নির্দেশ মেনে নিয়ে, পিকনিক জাতীয় হুল্লোড়বাজিতে যোগ দিতে হয়েছিলো।
সেদিন অবশ্য এতো সব না বুঝে খুব আনন্দের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিলাম। সে দিনটা আমার জীবনের একটা বিরলতম দিন, যে দিন বাবা-মা দুজনার হাত ধরে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। লালুমামার এসি গাড়ীতে চড়ে যাওয়ার মজা থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখও আমার স্পর্শ করলো না। লালুমামা, যিনি এই পিকনিকের প্রধান স্পনসর, তিনি তার নতুন কেনা মাটিজেই একা একা গেলেন। না, যে অনুষ্ঠানে আমার মা যান, সেখানে মামা তার পরিবার নিয়ে যেতেন না, হয়তো বা কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি avoid করার জন্য।
সাতটায় বাস ছাড়ার প্রোগ্রাম থাকলেও, সকলকে জড়ো করে বেরোতে বেরোতে সাড়ে আটটা বেজে গেলো। বাসেই প্রাথমিক ব্রেকফাস্ট হিসাবে সবাইকে পাউরুটি-মিষ্টি-কলা দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। মূর্তি পৌঁছতে প্রায় সাড়ে ন’টা বেজে গেলো। মূর্তি নদীর ধারেই একটা প্রাইভেট রিসর্ট ভাড়া করা হয়েছিলো, এই ব্যাপারটা লালুমামা স্পনসর করেছিলেন।
বাস থেকে নামতেই ক্যাটারারের লোকেরা হাতে হাতে লুচি-আলুরদমের প্লেট ধরিয়ে দিলো। সে সব খেয়ে-টেয়ে যে যার কাজে লেগে পড়লো। কিছু কাকীমা এবং তাদের প্রিয় দেওররা রান্নায় উৎসাহী হয়ে পড়লেন; তারা রান্নার ব্যাপার সাহায্য কম, ক্যাটারারের লোকদের বিরক্ত বেশী করছিলেন।
কয়েকজন দাদা ক্রিকেট খেলতে এবং কয়েকজন দিদি ব্যাডমিন্টন খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। একদল তাস নিয়ে বসে পড়লেন, আর কয়েকজন একটু আড়ালে গিয়ে মদ্যপানের আসর বসালেন। আমি আর ঈশানী শীতের মিঠে-কড়া রোদে মূর্তি নদীর হিমশীতল জলে পা ডুবিয়ে কমলালেবু ছাড়িয়ে খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম।
আমার বাবা এককাপ চা নিয়ে পার্টির দৈনিক মুখপত্র পড়তে লাগলেন। বাবা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পিকনিকে আসতে রাজী হলেও, তিনি তো এইসব মানুষের সাথে নিজেকে identify করতে পরেন না, বরং তিনি কুলি-কামিন-মজুরদের সঙ্গে অনেক comfort feel করেন। বাবার এই একা থাকাটা কারো কারো অসহ্য ঠেকলো। মদের আসর থেকে ‘ইউজ এন্ড থ্রো’ প্লাস্টিকের গ্লাসে রঙীন পানীয় নিয়ে, মিহিরকাকু ঈষৎ টলতে টলতে বাবার কাছে এসে বললেন, “কি কমরেড দেবু, এখানে একা একা বসে, কি বিপ্লব মারাচ্ছো?”
ছোটবেলা থেকেই অবিমিশ্র সুখ আমার কপালে সয় না। বেশ সুন্দর আমরা নদীর চরে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলাম, অন্তাক্ষরী খেলছিলাম। দারুন কাটছিলো দিনটা, হঠাৎই মিলিকাকিমাদের গ্রুপটা ওখানে এলো। আমাকে দেখেই কাকিমা বলে উঠলেন, “হ্যাঁ রে টুবলাই, তুই এখানে বসে মস্তি করছিস। আর ওখানে তোর বাবাকে সবাই খোরাক করছে।“ আরেকজন কাকিমা বললেন, “তোর মা কোথায় রে টুবলাই?” সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ফুট কাটলেন, “লালুদার-ও তো পাত্তা নেই।“ একটা হাসির রোল উঠলো ওদের মধ্যে।
আমি এক দৌড়ে বাবার কাছে এসে দেখলাম, বাবাকে মোটামুটি ঘিরে ধরেছে অনেকে, সবাই মিলে বাবাকে যাকে বলে, ‘চাটছে’; নেতৃত্বে অবশ্যই মিহিরকাকু। এই মিহিরকাকুকে আগেও লক্ষ্য করেছি বাবার প্রতি ভীষণ allergetic. আমাদের টাউনের খুব বনেদী বড়লোক ছিলেন ওরা। ওনার দাদুর বাবার ছিল শুঁটকি মাছের ব্যবসা; বাংলাদেশ থেকে শুঁটকি কিনে সারা উত্তরবঙ্গে সাপ্লাই করতেন।
এই ব্যবসা করে এতো পয়সা করেছিলেন, যে শোনা যায় উনি যেদিন যে ধুতি পড়তেন, পরদিন তার পাড় ছিঁড়ে চাকর-বাকরদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। টাউনে এবং গ্রামাঞ্চলে অনেক জমিজমা, সম্পত্তি করেছিলেন তিনি।
মিহিরকাকুর দাদুর আমল অবধি মোটামুটি ঠিকঠাকই চলেছে। কিন্তু ওনার বাবার আমল থেকেই পতনের শুরু। কাকুর বাবারা ছিলেন ছয়ভাই, সবকয়টি অকালকুষ্মান্ড। শুধু যে তারা অলস ছিলেন তাই নয়, ভোগবিলাসেও অভ্যস্ত ছিলেন তারা। বাপ-ঠাকুর্দার ব্যবসা বাড়ানো বা অন্তঃতপক্ষে টিকিয়ে রাখার বদলে একটার পর একটা সম্পত্তি বেচে খেয়েছেন। তাও যেটুকু ক্ষেত-জমি ছিল গ্রামের দিকে, ১৯৭৭ সালে সরকার পরিবর্তনের পর, সেটাও প্রায় হাতছাড়া হয়ে যায় অপারেশন বর্গা-য়। এই অপারেশন বাবার পার্টির অন্যতম achievement বলে মনে করা হয়।
মিহিরকাকুরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান। নিজেদের এই ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য, নিজেদের অলসতা, কর্মবিমুখতা, ভোগবিলাসিতার বদলে, তারা বাবার পার্টিকেই দায়ী করেন। আর সেই পার্টির একজন সক্রিয় কর্মীকে সামনে পেয়ে, মদ্যপ অবস্থায়, নিজের ক্ষোভ উগরে দেওয়ার সূযোগ তিনি ছাড়তে পারেন? সঙ্গে পোঁ ধরার জন্য আরো কিছু মাতাল সঙ্গীও পেয়ে গিয়েছেন তিনি।
বাবার দলের অনেক নেতা-কর্মীর অসাধু উপায়ে টাকা কামানোর জন্য, অনেকেরই ভেতরে ভেতরে রাগ ছিলো। আজ পেটে তরল পানীয় সেই উষ্মাকে গরলের মতো মুখ দিয়ে বার করছিলো। বাবার দলের এক শীর্ষ নেতার ছেলের ল্যাম্প কারখানার তিনশো টাকার চাকুরে থেকে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের মতো, শিল্পপতি হয়ে ওঠার ঘটনা থেকে লাল শালু পেতে, কিংবা কৌটো নাড়িয়ে প্রাসাদোপম পার্টি অফিস বানানো অবধি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাবাকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করা হচ্ছিলো। বাবা কিন্তু মাথা ঠান্ডা রেখে যুক্তি দিয়ে তাদের বক্তব্য খন্ডন করার চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু পেটে রঙীন তরল থাকলে অন্যের যুক্তি কেউ শুনতে চায়? যুক্তিতে না পেরে, আস্তে আস্তে আক্রমনটা ব্যক্তিগত হতে থাকে। কে একজন বলে উঠলেন, “আচ্ছা দেবুদা, আপনি কি বাড়ীতেও সমাজতন্ত্রের চাষ করেন? বাড়ির সব জিনিষই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেন?” প্রশ্নটার মধ্যে এত নোংরা ইঙ্গিত ছিলো, যে আমার কান লাল হয়ে গেলো। আমার বাবা কিন্তু এতোটাই সরল, যে এটাকে সিরিয়াস প্রশ্ন ভেবে সিরিয়াসলি এর উত্তর দিতে থাকলেন। আজকালকার দিনে এসব লোককে সরল নয়, বোকা বলে।
এই অবস্থা একমাত্র মা-ই সামলাতে পারবে। কিন্তু মা কোথায়? লালুমামাকেও দেখছি না। ওনার গাড়ীটাও রিসর্টের পার্কিং লটে নেই। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানলাম লালুবাবু কিছুক্ষণ আগে গাড়ী নিয়ে বেরিয়েছেন; আর হ্যাঁ, সঙ্গে এক ম্যাডামও ছিলেন। আমি রিসর্টের গেট খুলে দিকবিদিকশুন্য হয়ে ছুট লাগালাম। পিছন থেকে দারোয়ানটা চেঁচিয়ে উঠলো, “হে খোকি, অকেলা মত যাও। ইহা হাতি নিকলতা হ্যাঁয়।“