শহরের যান্ত্রিক শব্দ বহুল পরিচিত হর্ণ চোখটা খুলতে বাধ্য করল। বাজে কয়টা তা জানা নেই, তবে সকাল এর সময় তা বুঝতে দেরি হলো না, মশারি এর তিন্টে দড়ি হুক থেকে খুলে ফেলা হয়েছে আরেকটা আটকানো আছে, বিছানায় আমি শুয়ে আছি, বিছানার পাঁচ ভাগের দুই ভাগ মাত্র মশারি তে আবৃত, বাকি অংশে নেই, মশারি থেকে চোখ নড়াতেই পরিচিত সেই মুখ টা নজরে এল, সেই মেয়েটি, আমি জেগে উঠেছি তার কোন লক্ষন এখনো প্রকাশ করি নি, শুধু চোখটা খুলে চারপাশটা বুঝার চেষ্টা করছি, যা বুঝলাম তার বর্ণনাই দিচ্ছিলাম।
পরিচিত মুখটা উদাস হয়ে সামনে তাকিয়ে হাসছে, অদ্ভুদ হাসিটা সবসময় ই থাকে, তার মধ্যে কি লুকিয়ে তা শুধু সময়ই বলতে পারে,
হাসির মধ্যে উদাসিনতা বুঝলাম ওই মুখটার স্মৃতি মনে করে, আগের সময়টা মনে করে, যা মনে পড়ছিলো সবই কাটাময় স্মৃতি, কেন জানি না তবে সেই স্কুলের প্রথম দিনটা থেকে অনেকটা সময় একসাথে কাটিয়েছি, ভালো গুলো মনে পড়লোনা, শুধু দুঃখ আর মেয়েটার সময়ের সাথে বদলে যাওয়া, যুগের সাথে তারও পরিবর্তন, আর গ্রামে এক আর শহরে এসে আরেক ভাবটা ই মাথায় এলো তাই হাসিটা বড়ই বেদনাময় লাগলো।
দ্বিতীয় বিষয় যা মাথায় আসে নি তা হলো এত সকালে সে হাসার জন্য এলো কেন?
তখন সকাল কয়টা তা না জানার কারণেই প্রশ্নটা মাথায় এসেছিলো।
জেগে ঊঠার লক্ষন দেখানো মাত্র মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, আবারো সেই মিষ্টী কণ্ঠ উদাসিন লাগলো,
“এতক্ষন ঘুমাস কিজন্যে? কাজ-দান্দা নেই?”
এই মেয়ে হেসে খেলে রাগের কথাটা বললো, তবে কতক্ষন ঘুমালাম তা আমার এখনো বুঝা হয় নি,
ঘড়িতে তাকালাম বাজে সাড়ে ১১ টা,
“রাতে কাজ ছিলো, তুই এখানে কি?”
“আমার আসতে বারণ করেনি কেউ, আর রাতে ড্রিংকস করা কখন ধরলি তুই?”
এখন বিষয়টা মাথায় খেলেছে, কাল ভার্সিটির দুই বন্ধু মিলে দুঃখ ভুলাতে গিয়ে, দুই তিন গ্লাস পান করতে হলো, তারপরে তো আর মনে নেই।
“গত রাতেই”
“তুই ও তাহলে পালটে যাবি?”
ভেবাচেকা ময় এধরণের কথা শুনতেই খারাপ লাগে।
“তুর মতো আধুনিক হওয়ার ইচ্ছা নাই”
আমার এই কথায় মেয়েটা এবার নিজের দিকে তাকালো। এই আধুনিকে অনেক স্মৃতি বিজড়িত আছে,
শহরে কলেজে পড়তে এসে তার পরিবর্তন এমন ভাবে হলো যা সে কখনোই চায় নি, জিন্স আর শার্ট, বড় ভাইদের সাথে ঘুরা,পার্কে রাস্তায় আড্ডা, বহুল স্টাইলিশ ব্যাপার যা কিনা হলো রিলেশনশিপ, যেটা না করলে বল্লা-আনস্মার্ট ধরা হয়,
সো কলড পপুলার মডেল হওয়ার মানেই তার কাছে আধুনিকতা। কলেজে এসে এমন টাই তার সময় ছিলো, সাথে ছিলো আরেকটু আধুনিক যুগের কিছু নিদর্শন যেমন রাত্রিবেলা ঘুরাঘুরি, আর সিগারেট হাতে নেয়ার মতোই নিদর্শন,
আসলে তার স্মার্ট হওয়াই চাই,
কলেজের দু বছর এভাবে পাড়ি দেয়, শেষ মেশ ভার্সিটির এক বিষয়ে অনার্স নিয়ে বন্দি।তারপরো আগের স্বভাবগুলো এখনো যায় নি তার।
মেয়েটা নিজের দিকে তাকিয়ে এখনো নিজেকে আধুনিকতার এই ছাপে দেখতে পেল। এখনো শার্ট আর জিন্সে আর হাতে একটা সিগারেট,
আমার সামনে আধুনিক হয়ে স্মার্টনেস দেখাতে তার বোধ হয় লজ্জা লাগলো।
এই আধুনিকতা টা বর্তমানে রাস্তায় পাবলিকে দেখানো হলে স্মার্ট, তবে তাদের ঘরের লোকের সামনে ভুলেও এই স্মার্টনেস দেখাবে না,
কেননা সবার পরিবার ই আধুনিকতার আগের যুগের, সবার ফ্যামিলি টাই ভদ্র ফ্যামিলি তাই।
অতি পরিচিত মুখের সেই মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল আবারো, তবে হাসির ভেতরে উপরোক্ত চিন্তাগুলো স্পষ্টভাবে উঠে গেছে,
“আমি কি এতই আধুনিক নাকি রে?”
আজিব তার হাসি। স্মাইলি ফেইস -স্মাইল ছাড়া বাকি সব কিছুই বুঝিয়ে দেয়। এটা আমার কাছে একটা বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার।
“হুম, কেন এলি বল”
“তুই জানোস না”
“না,রাতে কি হোস্টেলে ছিলি নাকি বাইরে বাইরে
প্রস্টিটিউট গিরি করতে ব্যাস্ত ছিলি?
আমার এই কথা তার চোখের নিচে আলতো ছাপ আনলো, কান্না করবে তাহলে, না কাদার জন্য বলবো মাথা কাছে এনে জড়িয়ে ধরবো এমন ক্লোজ নয় ও আমার, যদিও বা ক্লাস ১ বা ওয়ান থেকেই আমার বান্ধবী পরিচিত মুখওয়ালা মেয়েটি তবে তা আধুনিকতার জন্য-ই দূরে সরে গেছে।
“এভাবে বললে যদি তুর শান্তি হয়, তাহলে ধরে নে আমি প্রস্টিটিউট”
“তুই আসলেই আধুনিক”
আমার এই আধুনিকতার কথাটা আবারো চোখের নিচে ছাপ ফেললো
এবারে কান্না গড়ালো তবে আড়াল করার জন্য আবারো স্মাইলি ফেইস ব্যবহার করা হচ্ছে, উদাসিন ভাবে আবারো সে হাসলো আর মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল।
আমি ধমক দিয়ে বললাম, “কেন আসলি বল আর বিদায় হ,”
এতে হাস্যকর কিছু নেই তারপরো আজিব সেই হাসি হাসতে নিজেকে ব্যাস্ত দেখালো, স্মাইলি ফেইস।
“যা ফ্রেশ হয়ে নে তো”
পরিচিত মুখওয়ালা আধুনিক মেয়েটির কথা আমার রাখতে হলো, ফ্রেশ হয়েই নিলাম,
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চিৎকার এলো,
“ইলহাম” “ইলহাম?” “ইলহাম!”
হুম পরিচিত মুখওয়ালা বলে মেয়েটার গলাও পরিচিত।
“আচ্ছা শোন আমার যেতে হবে, কি জন্য আসলাম তা পরে বলবো,বলার দরকার নেই সময়ে তুই জেনে যাবি”
হাসি আবারো, এই মেয়ের মার্ডার করবো আমি শুধু হাসির জন্যই,এই রাগ নিয়েই আমি জবাবটা দিলাম, “যা গা তো, ফাইজলামি করিস না,আর সিগারেট ফেল”
যেতে যেতে পরিচিত মুখওয়ালা মেয়েটি আমাকে দেখিয়ে-ই টান দিয়ে ধোয়া ছাড়ল,সিগারেট ফেলার কথাই আসে না।
আর মুখে সেই হাসি আবারো।
উফফ, এবার জানে মেরেই ফেলবো এই হাসির জন্য।
দুপুর সাড়ে এগারোটায় উঠেছিলাম, এখন ২ টা বাজে।
অশান্তি আর বেদনা নিয়ে বিছানার ঠিক ওই জায়গাতে আমি বসা, যেখানে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম মিমকে দেখেছিলাম, পরিচিত মুখওয়ালা মেয়েটা আরকি।
আজ তার জন্মদিন, তার সব বন্ধুর পার্টি আর সার্প্রাইজ দেয়া কে উপেক্ষা করে রাতেই আমার বাসায় এসেছিলো। ট্রীট আর কেক নিয়ে, রেস্টুরেন্ট এর গ্রিল আর বার্গার শর্মা ভর্তি প্যাকেট আর ফ্রিজের কেক যার একটা অংশ কাটা দেখে বুঝলাম, যে রাতে আমার সাথেই বার্থডে কেক কাটাতে এসেছিলো। আমি মদ খেয়ে বাসায় ঢুকে আধুনিকতা দেখালাম, আর সেই মেয়েটি একা একা তার কেক কাটলো, আমাকে শুইয়ে দিলো, মশারিটাও টাঙ্গালো আর সকাল পর্যন্ত উদাসিনতা নিয়ে কান্নাই করলো।
সকালে মশারি খুলে পাশে উদাস হাসিটা দিচ্ছিলো, কান্নার মাঝেও কি হাসিটা ছিলো। উফফ আবারো হাসির চিন্তা,
তার ১৯ তম জন্মদিন আজ।
হাজারো ফ্রেন্ড আর তার পাগলদের ভালোবাসা আধুনিক মেয়েটা,অতি পরিচিত মুখওয়ালা মেয়েটা বাদ দিয়ে এসেছিলো আমার কাছে তার জন্মদিন মানে শুভ দিনটা উদযাপন করতে।
আসার ই কথা, গত দুই বছর বাদে ১৯ বছরের বাকি সব সময়েই তার ঘনিষ্ঠজন আমি, যেই মেয়ের মা থাকেনা আর বাবার অডেল সম্পদ থাকার পরো তার ডল প্রিন্সেস নয় তার কাছে আমি অনাধুনিক ই বোধ হয় ঘনিষ্ঠজন।
আর হ্যা সারারাত ভর প্রস্টিটিউট গিরি করে নি।
এটা আমাকে কেমন জানি হাসালো, আই মিন উদাসিন হতাশা নিয়ে হাসিটা হাসালো।