কালো গোলাপ

কালো গোলাপ
অনল

– আজ তোমায় একটা ট্রাজেডি শোনাতেই হবে অনিলদা।
– আচ্ছা তবে আগে এক কাপ চা চাই। দুর্গাপুজোর অলসতা ভরা সান্ধিক আড্ডায় পাড়ার ছেলেরা এমন জোর করলো যে আর না করতে পারলাম না।
-বুঝলি আজ থেকে ২৩ বছর আগের ঘটনা বাবার বদলির চাকরি পোস্টিং হলো কুসুমগঞ্জ গ্রামের এক মফসল শহরে। ওখানে একটা হাই স্কুলের একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেলাম । কতগুলো ছেলের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব তৈরী হলো। তার মধ্যে যাকে নিয়ে আমাদের গল্প , সে হলো শুভ্র। শুভ্রকান্ত চ্যাটার্জী। নাম বললাম যখন তখন ওদের পরিবার সম্পর্কে কিছু ধারনা তোদের দিয়ে দি। রবীন্দ্রনাথের মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মিয়েছে সে আর তার বাড়ির অকার অহংকার বলতে গেলে যেকোনো জমিদার বাড়ির কথা আসতেই পারে।
– “তারমানে তোমার বন্ধু বিশাল বড়োলোক বলো।” – বললো রাজু।
হ্যা। ঠিক তাই। আর চ্যাটার্জী পরিবারের সর্বেসবা অন্যন্যময়ী দেবী। তার নামের সঙ্গে আমার নামের প্রথম দু অক্ষের মিল পেলেও তার চরিত্র আমার একদম বিপরীত। জমিদারি চলে গেছে ইংরেজ আমলে , কিন্তু মহিলার ভারিক্কি কথাবার্তা ও গম্ভীর্যময় চরিত্র তার একান্নবর্তী পরিবারকে সামলানোর ক্ষমতার যোগান দিতো।
এবার আমার বন্ধুটির কথায় আসি। ছোটবেলা থেকেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ফার্স্টই হয়ে এসেছি। কুসুমগঞ্জ হাই স্কুলে তার ব্যাতিক্রম হয়নি ঠিকই। কিন্তু শুভ্রর প্রতি আমার অতিরিক্ত নজর ছিলই। তার কাজকর্মই আমাকে তা করতে বাধ্য করেছিল। শুভ্রর মাথা মুন্ডুহীন প্রশ্নে যখন শিক্ষক্ষ দের অবস্থা শোচনীয়, তখন আমি পরে থাকতাম শুভ্রোর 10 মার্ক্স্ পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় ছেড়ে আসা নিয়ে। এখন শিকার করতে কোনো দ্বিধা নেই যে জ্ঞান ও বুদ্ধিতে শুভ্র আমার থেকে 10 নম্বর সবসময় এগিয়েই ।
মেঘমলা সেন
ওরা আমার এখনো পাগল ভাবে, আর তাই ,তাই এই নবমীর সন্ধ্যায় ওরা আমায় আটকে রেখেছে। এই ঘটনা থেকে মুক্তি কি পাওয়া সম্ভব নয়। সম্ভব। আমি আবারও লিখবো। পুটির দেওয়া ডাইরিটা … এই তো, এই তো। কেউ না শুনুক আজ ডাইরি আমার সমস্ত ঘটনা শুনবে, বলবো আমি। একাদশ শ্রেণীর মাঝামাঝি আমি আর্টস নিয়ে কুসুমগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। আগের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলো, আমার বাবা। তাই কোনো ক্রমে টেনে হিচড়ে মাধ্যমিক হলো পাস করেছিলাম। তবে ডাইরি, পড়াশুনোই কাঁচা হলেও আমায় মোটেও নিষ্কর্মা ভেবো না। আমি অহংকারের সাথেই বলতে পারি আমি খুব ভালো কবিতা লিখতাম আমি। আর জানো তো , কবিদের স্বভাব বৈশিষ্টের মধ্যে প্রেম একটা। আর সেই বিদ্যালয়ে প্রবেশের সাথে সাথেই আমার মধ্যে প্রথম সেই বৈশিষ্ট উকি মারতে আরম্ভ করলো। যৌবনে পদার্পন করলেও ইচ্ছা করেই হৃদয়ের কুমারীত্বকে কোন অতলে লুকিয়ে রেখেছিলাম ,কে জানে। কিন্তু স্কুলের একটি ছেলে সেদিন প্রেমেকে হাতিয়ার করে এমন বিদ্রোহ করলো যে সেই আমার মনের যৌবন শুরু হলো। এর আগে পর্যন্ত ইচ্ছা করেই প্রেম সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে কবিতা লিখতাম। স্বভাব গম্ভীর্যের অধিকারী বাবা পড়তে ভালোবাসতো আর স্কুলে গিয়ে তার সহকর্মী অর্থাৎ অন্যান্য মাস্টারমশাইদের দেখাতো ,তাই হয়তো। কিন্তু যখনি ওই ছেলেটির সঙ্গে চোখের মিলনে হৃদয়ের মিলন হওয়া শুরু হলো তখন থেকেই নিজের কবিতা নিজের কাছেই অচেনা হতে শুরু করলো। বাবার চোখ এড়ানোর জন্য কবিতার খাতার একটার পর একটা পাতা ছিড়তেও বাধ্য হচ্ছিলাম।

অনল
শুভ্র এমনিতে ছেলেটি লিডারগোছের ছিলো। অবশ্য এমনিই আমরা তাকে আমাদের নেতা করিনি তার যোগ্যতা অনুসারেই সে সেই সম্মান অধিকার করেছে। তাহলে খুলেই বলি। সেদিন ছিলো কুসুমগঞ্জের সঙ্গে চিরকালের বিজয়ী বাগবাজারের ইন্টার স্কুল ক্রিকেট কম্পিটেশন। ওই ম্যাচের উত্তেজনা আমাদের কাছে কোনো ভারত- পাকিস্তান ম্যাচের থেকে কম ছিলো না। সেই ম্যাচে বলতে গেলে প্রাণ বাজি রাখে শুভ্র। বাগবাজারের দুর্দান্ত এক ফার্স্ট বোলার ছিলো কিরন্ময় গাঙ্গুলি। পরে শুনেছি ছেলেটা রঞ্জিও খেলেছিলো। সেই কিরন্ময়ের বল আলোর গতিতে লেগেছিলো সোজা এসে লেগেছিলো শুভ্রোর কপালে ভ্রু থেকে আধ ইঞ্চি ওপরে। মাঠে কপাল ধরে বসে পরে শুভ্র, ওর কাছাকাছি যেতেই দেখি গোটা হাত রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে। সেদিন মাথায় ব্যাণ্ডেজ নিয়েও কোনো বলিউডের হিরোর মতো অত কঠিন ম্যাচ বার করে দেই ও। বাস শুভ্র সুস্থ হতেই ওই কাটা দাগটাই হিরো বানিয়ে দেই ওকে। সারা স্কুল তখন শুভ্রময়। আর কোন হিন্দি সিনেমাটা আছে বল যেখানে নায়ক আছে কিন্তু নায়িকা নেই। সেভাবেই শুভ্রর জীবনে একদিন পদার্পন করলো মেঘমলা সেন। আমাকে বলার দুদিনের মধ্যেই জোর করে একদিন বাসস্টপে কথা বলতে পাঠালাম শুভ্রকে মেঘোমালার কাছে। তারপর থেকে আমাদের খোশগল্প মানে আড্ডা আর কি, বেমালুম বন্ধ হয়ে গেলো। শুভ্র তখন একমাত্র বাসে মেঘোমালার পাশে নির্দিষ্ট সিটেই বসে। তবে আমাদের ওদের দেখে বেশ খুশি হতাম আমি। ভালোই লাগতো ওদের কথা বলা, হাত ধরা এই আর কি..
– ” ও অনলদা , তোমার এসব গল্প একটাও সত্যি নয়। প্রপোসাল দেওয়া নেওয়া হলো না , কোনো পক্ষ থেকেই হ্যাঁ বা না বলা হলো না আর কিনা প্রেম শুরু হয়ে গেলো। এ তো চূড়ান্তই অবাস্তব।” বললো নিপুন।
সব হবে বৎস। এতক্ষন যা শুনলে সবে এটা ট্রেলর ছিলো গোটা সিনেমাটা এখনো বাকি নিপুণবাবু।

নিপুন

বাকি সিনেমাটা রাজুর মুখেই দেখে থুড়ি শুনে নেবো বরং। আমার আজ একটু কাজ আছে গো, অনলদা। আজ উঠি।
ভাগ্গিস দেরি হয়নি, সারে নটার বাসটা আজ একটু দেরি করেছে তবে। ও ওই তো বাস। কিন্তু কি ব্যাপার পুটি আজ বাস থেকে নামলো না তো। তবে আজ কি পড়তে যায়নি তবে। ইস আসাটাই বৃথা হলো তবে।
-” ও: নিপুনদা। কি গো ভেবলার মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছ কেনো?”
এই দেখ। তোকেই তো খুঁজছিলাম। কি রে আজ তুই নটার বাসটা ধরিসনি তো?
– “না আজ ওই অংকের স্যার ছুটি দিয়ে কোথায় ঘুরতে গিয়েছে তো।তাই আর পড়াইনি।”
তাহলে আমায় একবার একটা ম্যাসেজ এমন দিতেই পারতিস।
– ” আরে বাবা ম্যাসেজ করলে কি আর একসাথে এটুকু হাঁটাটা হতো।” বলেই হেসে উঠলো পুটি।
এই হলো পুটি সদা চঞ্চল একেবারে উড়ন্ত। নামের মতোই সাইজে ছোটোখাটো কিন্তু বুদ্ধিতে আমায় ছাড়াতে পারে। বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি কিন্তু মুখে হাসি লেগেই আছে। আর হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে না ‘ হাসি তো ফাসি ‘ হ্যাঁ ওই ওই হইছে আমারো। আমার রাতের ঘুম না আসার কারণ এবং বিনা কারণে হেসে মুচকি হেসে ওঠার পর মায়ের বকুনি খাওয়ার কারনও যে ওই হাসিটি এটা বুঝতেই আমার আমার অনেক সময় লেগে গেছে। কিন্তু কোন অবাস্তব সংকোচে যে আজও সেই কথাটা জানানোর সাহস আমার হয়ে ওঠেনি তা জানিনা। আর তাই , তাই ওই নিপুনদা ‘দা’ নামেই সারা দিতে হয় আমাকে।
– ” কি গো নিজের মনে কি বিড়বিড় করছো।”
ছাড় , হ্যাঁ রে আজ সকালে যে মেলায় গেলি তা আমার জন্য কিছুই তো অনলি না?
– ” তোমার জন্য আবার কি আনবো , আর আমি যেন ছেলেদের পছন্দের অপছন্দের জিনিস বুঝি! আর তাছাড়া তোমার সাথে তো কাল যাচ্ছি। তখনই নিও না হয়।”
নিজের জন্য তো কাল কিনবি বললি, তাহলে আজ কি কিছুই কিনিসনি পুটি। বাব্বা তুই দিনদিন যা কিপ্টে হচ্ছিস।
ইয়ার্কিটা মনে হয় ভালো লাগলো না পুটির। হটাৎ একটু কি চিন্তা করে বললো ,
” আসলে আজ গিয়ে পিসিমনির জন্য টিপের পাতা কিনলাম। পিসিমনি সাজগোজ করতে কি ভালোবাসে গো।”
এই একটি জিনিস আমি পুটির বুঝতে পারিনা কোনোদিন। ওর পিসিমনির কথা উঠলেই কেমন যেন চুপচাপ কি উদাস হয়ে যাই। চিরকাল লেগে থাকা হাসিটা কথায় উধাও হয়ে যাই। খুব অদ্ভুত ভাবে কালই প্রথম পুটির পিসিমনিকে প্যান্ডেলে দেখলাম পুজো দিতে, এতদিন আছি এই পাড়ায় কোনোদিন দেখিনি তো, জানতামই না ওদের বাড়িতে পুটির বাবা , মা আর ও ছাড়াও ওই ভদ্রমহিলাও থাকেন। তবে এটা ঠিক যে মহিলা সত্যিই সাজতে ভালোবাসেন। নয়তো এই বয়সে ওরকম দুর্গা ঠাকুরের প্রতিরূপ ধরে রাখা তো আর সহজ কথা নয়। পুটিকে এসব নিয়ে জিজ্ঞেস করতেই ও বললো,
” তুমি তো পিসিমনিকে কমবয়সে দেখোইনি গো। এখন তো চুলে পাক ধরেছে , চামড়াও কুঁচকে গেছে তাই….”
পাকলে আমাদের চুলও একসাথেই পাকুক, চামড়া কুচকালেও একসাথেই কুচকাক। একসাথে বৃদ্ধ হবি পুটি। এভাবেই পূর্ণিমার আলোয় তোর সাথে বাকি জীবনটা হাঁটতে চায় পুটি।
” ও নিপুনদা আর কতদূর যাবে পৌঁছে গেছি তো বাড়ি। তাহলে আজ এলাম। কাল সকালে আবার দেখা হচ্ছে তাহলে , পুজো মণ্ডপে দেরি করো না আবার। আর দয়া করে সকালে স্নানটা করে এসো। ”
কোথায় যে কথা বলতে বলতে হারিয়ে গিয়েছিলাম, যাক পুটি মনে কিছু বুঝতে পারেনি। আচ্ছা এভাবে কি চলা যায় মনে মনে বিড়বিড় করতে করতে কোনোদিন কে শুনে ফেলবে আর তার পর কি যে বাজে পরিস্থিতি তৈরী হবে! না , অনলদার সাথে একবার এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে হবে যদি কোনো সুপরামর্শ দিতে পারে..।

মেঘমালা সেন
– ” কি লিখছো , পিসিমনি? এত গম্ভীর হয়ে”
আরে পুটি, এসেছিস। হ্যাঁ রে কেমন মেলা ঘুরলি?
– ” এই দেখো পিসিমনি , তোমার জন্য মেলা থেকে টিপ এনেছি।”
বা: , দারুন তো।
– ” পড়ো। তোমায় খুব সুন্দর। ওই দেখো মা আবার ডাকাডাকি শুরু করেছে।”
ডাইরি তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না শুভ্র একদিন নিজে থেকেই আলাপ করে কথা বলা শুরু করলো। প্রথমে তো কোনো অচেনা ছেলের সাথে কথা বলবো ভেবেই ভয় পাচ্ছিলাম তবে দেখে বুঝলাম যে আমার সাথে কথা বলতে এসে শুভ্র আমার থেকেও বেশি নার্ভাস। তার পর আর কি, আমিই সাহস দিলাম ওকে। কথা বলতে বলতে এভাবেই একদিন আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। সত্যি বলতে কি, ওর নাম শুনতাম স্কুলে খুব, চিনতাম না তবে , অবশ্য ক্রিকেট নিয়ে অত আগ্রহ ছিলো না তাই হয়তো। কিন্তু তা যার নাম গোটা স্কুল জুড়ে শুনতাম তাকে একবার চোখে দেখার ইচ্ছা তো ছিলই। তাই সেদিন আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তবে তার প্রেম পরিণতি যে এত শীঘ্রয় হবে হলো ভাবিনি। ওর সাথে বাসে একসাথে সময় কাটাতে বেশ লাগতো আমার। মনে হতো , স্কুল ইচ্ছা করেই রোজ দু পা দু পা করে এগিয়ে আসে আমরা যাতে বাসে বেশি সময় না কাটাতে পারি। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে , অস্ত যাওয়া সূর্যকে সাক্ষী রেখে আমাদের প্রেমপর্বের আরম্ভ হলো একটা চিঠিকে কেন্দ্র করে। বাস থেকে নেমে সবে মাত্র হাঁটতে শুরু করেছি আর লক্ষ করছি শুভ্রর অস্বস্তি বোধ। সেদিন কারো অস্বস্তির কারণ হতে পেরে অদ্ভুত আনন্দে আপন মনে হেসে উঠেছিলাম। হটাৎই শুভ্রর পকেট থেকে একটা চিঠি দৃশ্যমান হলো। সে সেটা কোনোক্রমে আমার হাতে দিয়েই সাময়িক লজ্জা থেকে পালিয়ে বাঁচলো। উত্তর জানানোর যথাযোগ্য পথ ও সময় দুটোরি সুস্পষ্ট উল্লেখ ছিলো চিঠিতে। এভাবেই নাটকীয় ভাবে আমাদের প্রেমপর্ব শুরু হলো। দুবছর এমন কোনো দিন নেই যে আমরা দুজন একবারের জন্য আলাদা হয়েছি। সূর্যাস্তে শুভ্র আমায় মৃত্যুও আমাদের কোনোদিন আলাদা করতে না পারার কথা বলত তারপর আমাদের ঠোঁট স্পর্শ করে যেতো।নাটকীয় তো দিনগুলো চলে যেতে পারতো কিন্তু হটাৎ একদিন শুভ্র যোগাযোগ করা বদ্ধ করে দিলো। অনেক বৃথা উত্তরের করেও এমন কোনো চিটি এলো না যেখানে আমাদের দৃষ্টি বিনিময়ের স্থান এবং সময় উল্লেখ থাকবে। যখন সব আশা ছেড়ে নিজেই শুভ্রকে খুজতে যাবো বলে ভেবেছি তখনি থেকে থেকে আমার সমন্ধ এলো সেদিন বিয়ে করবো না পণ নিয়ে নিরুদ্দেশি হলাম। তারপর তেত্রিশ বছর এক আশ্রমে কাটানোর পর পুটির বাবা , আমার মেজদা আমায় তার বাড়িতে আশ্রয় দিলো। এখনো নিঃস্বার্থ ভাবে তোমায় খুঁজে চলেছি শুভ্র। তুমি যে প্রতিজ্ঞা আমায় করেছিলে হলো কি তবে নাম্মাত্রই আমার নাকি কোনো এক শেষ উপায় আছে তোমার সাথে দেখা করার।
বহুদিন আগে মাএর কাছে শুনতাম জমের ডাকের সতর্কবানী স্বয়ং যমযাত্রী আগে পাই। তারই
কি ইঙ্গিত আসছে অন্তর থেকে? তা পণ হলে এই ঘটনা তোমাকে শোনাবার কি করন, ডাইরি।

নিপুন

কালকের ঘটনাটা যে কিভাবে ঘটে গেলো তার কোনো বিবরণই নিজেকে দিতে পারছি না। যতবার যুক্তিগুলকে সাজিয়ে নিজের মনকে সন্তনা দিচ্ছি ততবারই হলো তাসের ঘরের মতো যুক্তিগুলো ভুপতিত হচ্ছে। এই অস্থিরতার মূল কেন্দ্রবিন্দু ঐ অনলদা। কাল শুধুমাত্র অনলদার পরামর্শেই মেলা থেকে ফেরার পথে চিঠিটা পুটির হাতে গুঁজে দিয়েছিলাম। তারপর থেকেই পুটির সাথে যোগাযোগ চ্ছিন্নভিন্ন, পুটিও তারপর থেকে ম্যাসেজ করেনি আর আমিও সাহসের অভাবে ওকে কোনো কথা বলার পরিস্থিতিতেই নেই। তবে আমি শান্তিপ্রিয় বাঙালির মতো এর একটা ভালো দিক খুঁজে বের করেছি। আজ দশমীর সকালে আমার এরকম অস্বস্তি বা চিন্তা আসলে আমার নিখাদ ভালোবাসাকেই তো বোঝাচ্ছে। কাউকে এতটা ভালোবাসতে পেরেছি বলে নিজের ওপর একটু গর্ব আমার করা সাজেই। সূর্যদেবের ঔজ্জ্বল্য ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে নিজের মনে বেশি ভেবে আর দেরি করে কোনো লাভ নেই সত্যিকে সামনে থেকে মেনে নেবো তা সে যাই হোক না কেন!
একি হটাৎ এখন পুটির ফোন। এতক্ষনে নিশ্চই চিঠি দেখে রেগে গিয়ে আমায় ফোন করেছে। এখুনি তো দেখা হতো ওখানেই সামনা সামনি না হয় প্রত্যাক্ষিত করতে পারতো আমায়। ‘শুভস্ব শ্রীঘ্রম্’ শুনে ছিলাম , খারাপ খবর ও তাড়াতাড়ি দিতে হয় ভাবিনি
হ্যালো পুটি।
– “নিপুনদা অদ্ভুত বিপদে পরে তোমায় ফোন করলাম গো, এই দেখো না পিসিমনি কেমন যেন নিথর হয়ে গেছে , সারাও দিচ্ছে না , কথাও বলছে না, তুমি প্লিজ খরতার ডাক্তার নিয়ে এসো।”

অনল
নিপুন এত সকালে, আয় বস , এত হাপাচ্ছিস কেনো?
-” তুমি তাড়াতাড়ি একবার পুটিদের বাড়ি চলো অনলদা। ওর পিসিমনি খুব অসুস্থ।”
আচ্ছা চ! দেখি।

মেঘ! একি তুমি মেঘ , এতবছর পর তোমার সাথে আমার এই অবস্থায় দেখা হলো। তেত্রিশ বছর ধরে ভালোবেসে শেষে মিলনের সময় তোমার এরূপ আমি দেখবো আমি ভাবিনি, মেঘ। তুমি কি আমাকে , তোমাকে না বলে ডাক্তারি পড়তে চলে যাওয়ার প্রতিশোধ নিচ্ছ। তবে একবার হ্যাঁ বলে আমায় উঠে জড়িয়ে ধরো। আমার একটা চিঠিও তবে তোমার কাছে পৌঁছায়নি। আমার বিদেশে চলে যাওয়ার আগে আমার মা আমায় তোমার সাথে যোগাযোগ রাখতে বারণ করে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল কিন্ত তখন আমি কথা দিয়েছিলো যে ফিরে এসে আমি একমাত্র তোমাকেই বিয়ে করবো। সেই তখন থেকে কুসুমগঞ্জের রাস্তায় তোমায় কত্ত খুঁজেছি। তারপর এখানে এসে উঠেছি কিন্তু দেখো আমরা এত কাছে থেকেও শেষে এক হতে পারলাম মৃত্যুর কোলে শুয়ে। তোমার মনে আছে আমার দেওয়া প্রত্তিজ্ঞার কথা ” মৃত্যু ও আমাদের আলাদা করতে পারবে না” আজ আমাকে তাই প্রমান করে যেতে হবে। তুমি যেখানে গিয়েছ আমাদের সংসার সেখানেই গড়ে উঠবে।

নিপুন

জানিস পুটি , আজ অনলদার মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে শুভ্রকান্ত চ্যাটার্জির ওপরের দু ইঞ্চি ওপরের কাটা দাগটার কথা মনে পড়ছে। নিজের ট্রাজিক গল্পের শেষটা যে এভাবে লেখা হবে তার ধারণা লেখক ও পাই না আগে থেকে। আজ তুই যেমন আমার বহুতে আবদ্ধ , ধীর , শৃঙ্খলিত , চঞ্চলবিমুখ , তেমন সামনের চিতা দুটোর চঞ্চল্বিমুখতা, স্থির থাকা ওদের প্রতিজ্ঞা পূরণের প্রতিক। এই গোলাপ, গোলাপ হলেও তা ভালোবাসার বদলে মৃত্যুকে প্রদর্শন করে।

“নীরব কণ্ঠে শান্ত দুটি চোখে,
তোমার কি প্রাপ্য শুধুই শুভ্র মেঘোমাল্য”