পারিজাকে কেউ হয়তো রুমে নিয়ে গিয়েছে। ওর খোঁজ একবার করবে, ভাবল নির্জন। পরে নাকচ করল সে চিন্তা, মাথাটাকে পরিষ্কার করতে হবে আগে- শান্ত হতে হবে, হতে হবে স্থির।
রুপাকে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে নিয়ে, হাত ধরে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে এলো নির্জন। বলল, “পুলিশ আসবে! এসে আমাদের জেরা করবে। তুমি বলবে, তুমি আমার গফ, ঘুরতে এসেছি। কী কর জিজ্ঞেস করলে বলবে, বেকার, বিসিএসের প্রিপারেশন নিচ্ছো।”
কথাগুলো একটানা বলে থামল নির্জন। তারপর আবার বলল, “আর আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে, ফ্রিল্যান্সিং করি। ওকে?”
নিশ্চল চোখে রুপা তাকিয়ে ছিল নির্জনের দিকে। জিজ্ঞেস করল, “যদি জানতে চায় কীসের কাজ করেন?”
ভাবল একটু নির্জন। তারপর বলল, “উম্মম… বলবে ডেটা এন্ট্রি, ফটোশপ, আর্টিকেল রাইটিং, পেইড রিভিউ – এগুলাই। আমার ফাইবারে, আপওয়ার্কে একাউন্ট আছে, সমস্যা নেই!”
ঠিক তখনই সাইরেনের শব্দ তুলে হোটেলের মূল গেট দিয়ে ঢুকল পুলিশ ভ্যান। সন্ত্রস্ত হয়ে গেলো কৌতূহলী লোকজন।
নির্জন নিকোটিনের অভাব বোধ করছিল অনেকক্ষণ যাবত। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সিগারেট জ্বালল ও।
রুপা প্রায় উচ্চস্বরে বলে উঠল “আপনি স্বাভাবিক আছেন কী করে? আমি তো মেনেই নিতে পারছি না! আমাদের পাশের রুমে একজনকে খুন করে চলে গেছে কেউ! আমাদের পাশের রুমে!”
“আমি এখনো ভাবার সময় পাইনি, রুপা! তাই স্বাভাবিক থাকতে পারছি!”
নিচে নামার সময় প্রথমবারের মতো লক্ষ্য করল নির্জন, দুইতলা কিংবা তিনতলায় কোন সিসি ক্যামেরা নেই! একটা ক্যামেরা আছে শুধু হোটেলের রিসেপশনে।
পুলিশের দলটা এর মধ্যেই চলে গিয়েছে সিনে, একজন পুলিশ অফিসার কথা বলছে রিসেপশনিস্টের সাথে।
লনে এসে দাঁড়াল ওরা দুজন। কাল, ২২ কিংবা ২৪ ঘণ্টা আগে এই সময়েই কথা হয়েছিল তাহমিনা হায়াতের সঙ্গে। আর আজ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মরদেহ, নিজঘরেই নগ্ন অবস্থায়!
“আমাদের পাশের ঘরে!”, হাত পা ছুঁড়ে বলল রুপা, “আমরা যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন কেউ একজন তাহমিনা হায়াতের গলায় ছুরি চালিয়েছে! ও মাই গড!”
“আমরা বুঝতে পারিনি! একটা মাত্র দেয়াল ছিল মাঝে! তাহমিনা হায়াতকে চুদলেও আমরা বুঝি আর ওকে একজন মেরে ফেলল, বুঝিনি!”
আবারও বলল রুপা। ঘুমজাগা ভাব এখনো ওর মুখে- কিছুটা ফুলেছে মুখ, এলোমেলো হয়ে আছে চুলগুলো।
“আমরা খুব ক্লান্ত ছিলাম, রুপা!”, সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বলল নির্জন। “খুনি ছুরির একটানে তাহমিনা হায়াতের ভোকাল কর্ডটাই ফাঁক করে দিয়েছে- উনি শব্দ করার সুযোগটাও পাননি!”
হোটেলের মূল ফটকেও এসে দাঁড়িয়েছে অনেকে- শ্রমিক শ্রেণির, হয়তো কাজ করে চা বাগানেই, সাহস পাচ্ছে না ভেতরে আসার। সবার চোখ তিনতলার দিকে জনসমাগমের দিকে।
“কোথায় যেন পড়েছিলাম, নারীর খুনের ক্ষেত্রে ৯০% সময় স্বামীর হাত থাকে, কোন না কোন ভাবে। তাহমিনা হায়াতের বেলাতেও তাই দেখছি!”
“জুলফিকার আমান খুনটা করেছেন, বলতে চাচ্ছেন!”
“নিজে না করলেও, কাউকে দিয়ে হয়তো করিয়েছেন। যে লোক স্ত্রীর পেছনে ইনভেস্টিগেটর লাগাতে পারে, সেই লোকই কি এসাসিন এসাইন করতে পারে না? খুব কি অসম্ভব?”
“বাংলাদেশে এসাসিন? হলিউড মুভি পেয়েছেন?”, বক্রোক্তি করল রুপা।
“ডার্ক ওয়েব, ডিপ ওয়েব সম্পর্কে ধারণা এখন সবার আছে, রুপা”, সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল নির্জন।
“১৮ কোটির দেশ- প্রফেশনাল কিলার যে নেই, সে কথা হলফ করে বলা যায়?। একসময় মুরগি মিলন, কালা জাহাঙ্গীর, ব্যাঙ্গা বাবু এরা ঢাকায় রাজত্ব করত। ওরা সবাই কিলার পুষত। সবাই একেকজন গডফাদার, শীর্ষ সন্ত্রাসী। একটা ফোন কলেই কোটি কোটি টাকা চাঁদা দিত বড় বড় ব্যবসায়ীরা। কালা জাহাঙ্গীর এখনো ফেরার, ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে পর্যন্ত তার নাম আছে। যে দেশের এরা জন্মাতে পারে, সে দেশে এসাসিন নেই, এটা মানার মতো না!”
তাহমিনা হায়াতের মরদেহটা বারবার ভাসছে নির্জনের চোখে। সে ছবি সরাতেই এতগুলো কথা বলল নির্জন।
“চিন্তা করো! জুলফিকার আমান আমাদের এসাইন করেও পরে পিছিয়ে যেতে বললেন। হয়তো আমাদের সাথে যোগাযোগের পর এসাসিনদের সাথে কথে বলেছে। আমরা নজর রাখলে এসাসিনের অসুবিধা হতে পারে ভেবে আমাদের পিছিয়ে যেতে বলেছেন! পরশু এসে নিজেই অবস্থা দেখে গেছে। আর উনি চলে যেতেই খুন! ব্যাপারটা মিলে যাচ্ছে কিনা!”
“কিন্তু কিলার ঢুকবে কোনোদিক দিয়ে? ক্যামেরা আছে!”
হাসল নির্জন। বলল, “মুরগি মিলনকে আদালত চত্বরে হত্যা করা হয়েছিল, রুপা! অবশ্য সে উদাহরণ এখানে দেয়া চলে না। বললাম এটা বোঝাতে যে ওরা যে কোন কাজ করতে পারে! ছাদে গিয়েছিলে হোটেলের?”
“না! ছাদে যাওয়ার সুযোগ পেলাম কৈ!”, বলল রুপা, বাড়তে থাকা লোকসমাগমের দিকে তাকিয়ে।
“আমি গিয়েছিলাম। পুরো হোটেলে শুধু একটাই ক্যামেরা, রিসেপশনে। ছাদের ঠিক পাশেই বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ আছে। চাইলেই যে কেউ গাছ বেয়ে ছাদে উঠতে পারে। আর ছাদের দরজা খোলা থাকে সারারাত!”
“কিন্তু এরা প্রত্যেক ফ্লোরে ক্যামেরা লাগায়নি কেন!”, অবাক জিজ্ঞাসা রুপার।
“মনে হয়, প্রাইভেসির কথা ভেবে”, বলল নির্জন। “প্যাসেজে কতজন কতভাবে থাকে। কতধরণের লোক আসে- কেউ আনে বেশ্যা- কেউ চাইবে না সিসিটিভিতে ধরা পড়ুক!”
সিএনজি থামার শব্দে গেটের দিকে তাকাল নির্জন। অধ্যাপক মনোয়ার ওমর সিএনজি থেকে নেমেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে আরম্ভ করলেন রিসেপশনের দিকে।
***
“আপনারা তো পাশের রুমেই ছিলেন, কোন শব্দ পাননি?”
“না!”
“চিৎকারের শব্দ বা কোন আনইউজুয়াল শব্দ?”
“না!”
“শোনার কথা। পাশের রুমে একজনকে মেরে ফেলা হলো আর আপনারা বুঝলেন না?”
“আমরা কাল সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছি, পাহাড়ে উঠেছি নেমেছি- অনেক ক্লান্ত ছিলাম।”
“আপনারা বিবাহিত নন, তাই তো? তা উনি আপনার কে হন?”
“প্রেমিকা!”
“বিয়ের আগেই হানিমুন! বেশ ভালোই!”
“এটা কোন অপরাধ নয়। আমরা দুজনই পূর্ণবয়স্ক।”
“সে কথা বলছি না। আপনারা কবে উঠেছেন হোটেলে?”
“পরশু সকালে।“
“তাহমিনা হায়াতও পরশু সকালে উঠেছেন। আপনারা পূর্ব পরিচিত?”
“না। একদম না!”
“একজন বয় বলেছে, আপনার সাথে নাকি তাহমিনা হায়াতকে কথা বলতে দেখেছে।“
“হ্যাঁ। কথা বলেছিলাম। স্ট্রেঞ্জার টক, যা হয় আরকি। এর বেশি কিছু নয়।”
“কী বলেছিলেন উনি আপনাকে?”
“মনে রাখার মতো তেমন কিছুই নয়। নামধাম, এসবই।“
“কী করেন আপনি?”
“ফ্রিল্যান্সার।“
“ফ্রিল্যান্সিং করে এমন অভিজাত হোটেলে থাকার সামর্থ হয়?”
“ফ্রিল্যান্সারদের সম্পর্কে আপনার ধারণা খুব কম বোধহয়। আমি আপনার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আয় করি, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ অন্তত!”
“আমার আয়ের হিসেব আপনার করতে হবে না। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন!”
“আচ্ছা!”
“আপনার প্রেমিকা- কী নাম বললেন? রুপা- কতদিনের পরিচয়? কী করেন উনি?”
“পরিচয় অনেকদিনের। রিলেশন বেশিদিনের নয়। ও চাকরির প্রিপারেশন নিচ্ছে।”
“আপনার আর মিস রুপার সম্পর্কটা ঠিক কী ধরণের?”
“আপনি খুনের চেয়ে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী দেখছি!”
“আপনি খুব বেশি কথা বলছে, মিস্টার নির্জন। সে প্রশ্ন করছি, সেটার উত্তর দিন!”
“আমরা বিয়ে করব ভাবছি। তাই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঠিক আছে কিনা দেখতে এখানে এসেছি। এখন ক্লিয়ার হয়েছে?”
“আপনাদের শ্রীমঙ্গলে আসার কারণটা শুধু এটাই?”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। সেই সাথে ঘোরাও!”
“আপনি বলছেন, আপনার সাথে তাহমিনা হায়াতের সামান্য কথা হয়েছে। আর হোটেলের স্টাফ একজন বলল, আপনি নাকি রীতিমত গান গেয়ে শুনিয়েছেন ওকে!”
“আমি গান গাই, গিটারও বাজাই। আপনি শুনতে চাইলে, আপনাকেও শোনাতে পারি, শুনবেন?”
“সামান্য পরিচয়েই গানে গানে আড্ডা জমে?”
“ওরা গান গাইছিল। আমি গিয়ে যোগ দিয়েছি, এই যা!”
“কতদিনের থাকার প্ল্যান নিয়ে শ্রীমঙ্গলে এসেছেন?”
“সাত আটদিন! তবে এখন মনে হচ্ছে ট্যুরটাকে শর্ট করতে হবে!”
“তাহমিনা হায়াতকে সর্বশেষ কখন আপনি জীবিত অবস্থায় দেখেন?”
“কাল সন্ধ্যায়!”
“আর মৃত অবস্থায়? মানে কখন জানতে পারেন যে তাকে খুন করা হয়েছে!”
“আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই। একজনের চিৎকারে ঘর থেকে বেরিয়ে…”
“তার আগে কী করছিলেন আপনি?”
“কীসের আগে?”
“লাশটা দেখার আগে?”
“উই অয়্যার মেকিং লাভ!”
“মেকিং লাভ? ইউ মিন সেক্স?”
“ইয়েস! আই মিন সেক্স!”
“সেক্সের মাঝে উঠে আসেন নাকি শেষ করে?”
“এটা রিলেভেন্ট?”
“অবশ্যই। সব প্রশ্নই রিলেভেন্ট!”
“সেক্সের মাঝে উঠে এসেছি আমি!”
“কী দেখেছিলেন আপনি?”
“কয়েকজন বয় ওনার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর একজন চিৎকার করে লোক জড়ো করছে। আর লাশটা বিছানার মাঝে পড়ে আছে।“
“আপনি রুমের ভিতরে ঢুকেছিলেন?”
“হ্যাঁ!”
“আপনি ছাড়াও আরো ক’জন রুমে ভেতরে গিয়েছিলেন?”
“তিন চারজন। শুরুর দিকে। আমি একজ্যাক্ট সংখ্যাটা বলতে পারছি না।“
“আপনি ভেতরে ঢুকেছিলেন কেন? বাইরে থেকেও দেখতে পারতেন!”
“কৌতূহল থেকে!”
“আপনি কি কাউকে লাশটা ছুঁতে দেখেছিলেন?”
“না।“
“আপনি লাশটাকে নগ্ন দেখেছিলেন?”
“হ্যাঁ!”
“কিন্তু আমরা এসে দেখেছি, কেউ একজন লাশটার গায়ে চাদর ঢেকে দিয়েছে। কে চাদর দিয়েছে, দেখেছেন?”
“না!”
“ওর ছাত্রীকে আপনি কতটুকু চেনেন?”
“খুব বেশি না। সামান্য আলাপ।“
“সামান্য আলাপ? আমি সিওর?”
“হ্যাঁ!”
“আমরা তাহমিনা হায়াতের ছাত্রীর সাথে কথা বলেছি। বলেছে, আপনাকে উনি চেনেনা। আপনি বলছেন, চেনেন। কার কথা সত্য?”
“তার সাথে আমার সামান্য আলাপ হয়েছে। ও প্রচণ্ড সুন্দরী। আমার মনে থাকারই কথা, তার হয়তো আমাকে মনে নাও থাকতে পারে!”
“ছাত্রীর সাথে ওনার সম্পর্ক কেমন ছিল বলে আপনার মনে হয়েছে?”
“ভালোই। খারাপ কিছুই আমার চোখে পড়েনি।“
“হোটেলে সন্দেহজনক কাউকে দেখেছিলেন?”
“না।“
“হুম…আপনার ঠিকানাটা লিখে দেবেন এখানে। ফোন নাম্বারটাও। আপনার সাথে আমরা যোগাযোগ করতে করতে পারি আবার। আশা করি সহযোগিতা করবেন!”
“কী জিজ্ঞেস করল তোমাকে?”
থানার কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে প্রশ্ন করল নির্জন। তাহমিনা হায়াতের লাশ থানার কম্পাউন্ডেই রাখা হয়েছে, থানার বাইরে উপচে পড়ছে ভিড়। কয়েকজন সাংবাদিককেও ঘোরাফেরা করতে দেখল নির্জন।
“কী করি, কেন এসেছি, কিছু বুঝেছি কিনা, পূর্বপরিচিত কিনা এসব!”