প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর ৪

প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর- ৩

হাঁটু পর্যন্ত লম্বা গুলিস্তানে কেনা সস্তা কোট, হাতে হাতমোজা, মাথায় বাদুরে টুপি, গলায় প্যাঁচানো মাফলার- নির্জনকে দেখে মনে হতেই পারে ও সদ্য ইগলু থেকে বেরিয়েছে। সন্ধ্যায় ঝন্টু মুখে লাগিয়ে দিয়েছে ফ্রেন্সকাট দাড়ি। গালে সেটে দিয়েছে শ্রীলঙ্কা সাইজের আচুল। ওকে দেখাচ্ছিল আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া অশিক্ষিত ব্যবসায়ীদের মতো। চুন দিয়ে পান খেয়েছে দুটো কাঁচা সুপারির, রক্তলাল হয়ে আছে ঠোঁট।
রুপা বলল, “আপনার এই অদ্ভুত পোশাকের জন্য সবাই তাকাচ্ছে। ছদ্মবেশ নিলে এমন ছদ্মবেশ নেয়া উচিত, যাতে কেউ ফিরেও না তাকায়! এর চেয়ে স্বাভাবিকভাবে এলেই পারতেন!”
নির্জন সকাল থেকে একটাও সিগারেট খায়নি, পণ করেছে, অন্তত একটা দিন ও সিগারেট ছোঁবে না। বলল, “লোকে দেখছে বটে কিন্তু মনে রাখবে শুধু আমার পোশাক, ফ্রেন্সকাট দাড়ি আর এই ভোটকা আচুলটা, চেহারা মনে রাখবে না কেউ! আর চেহারা ঢাকতেই তো ছদ্মবেশ!”
বোরখায় আপাদমস্তক মোড়া রুপার দিকে তাকিয়ে বলল, “হাইটটা একটু কম হলে তোমার মতো বোরখাই ট্রাই করতাম!”
তাহমিনা হায়াত এন্ড টিম উপবন এক্সপ্রেসের একটা আস্ত ডাবল এসি কেবিন রিজার্ভ করেছে। স্টেশনে কাল দু’বার গিয়েও নির্জন কেবিনের রিজার্ভেশন পায়নি। আজ ঝন্টু এসে ঠিক জায়গায় টাকা খাইয়ে ম্যানেজ করেছে দিয়েছে একদম শেষ মুহূর্তে।
ট্রেন ছাড়ার আর মিনিট কয়েক বাকি। নির্জন আজকের একটা যুগান্তর কিনে মুখের সামনে মেলে ধরে চেলসি আর আর্সেনালের ম্যাচের খবর পড়তে লাগল।
“ওদের তো কাউকে দেখছি না এখনো!”, উদ্বিগ্ন হয়ে বলল রুপা। “সাডেন চেঞ্জ অফ প্ল্যান হতে পারে কি?”
পত্রিকাটা থেকে চোখ না সরিয়েই নির্জন বলল, “ওরা না এলেও আমরা যাচ্ছি! একবার ট্রেনের টিকেট কেটে ফেলেছি যখন, না গিয়ে ফিরছি না!”
ঠিক তখনই তাহমিনা হায়াতকে দেখতে পেল নির্জন চোখের কোণে। হন্তদমত হয়ে আসছেন ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। সাথে ওভারকোট গায়ে লম্বা এক ভদ্রলোক। এর কথাই বোধহয় বলেছিলেন জুলফিকার সাহেব। অধ্যাপক মনোয়ার ওমর। একজন বয়স্ক রোগা কুলি মালসামান বয়ে আনছে ট্রলিতে।
কমলাপুর স্টেশনের উজ্জ্বল আলোয় সামনে থেকে তাহমিনা হায়াতকে দেখে হাঁ হয়ে গেল নির্জন; তার ল্যাটিনো গালে আলো এসে পিছলে যাচ্ছে যেন! স্কাই ব্লু ফেডেড জিন্স, পুরু লেদারের তামাটে জ্যাকেট, টানটান করে বাঁধা চুল- হাঁটছেন যেন মরালীর মতো- চিরউন্নত গ্রীবা। হাঁটার ছন্দে কাঁপছে সারা দেহের উচ্ছল মাংস আর সুউচ্চ উদ্ধত স্তন। মধ্য যৌবনের সালমা হায়েককে মনে পড়ে গেল নির্জনের।
রুপা লাগেজ নিয়ে উঠে পড়েছে ট্রেনে। ট্রেন ছাড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এক প্যাকেট গোল্ডলিফ কিনল নির্জন! ট্রেনে যদি হঠাত খুব টানতে ইচ্ছে করে আর না পাওয়া যায় সিগারেট? হাঁ-হুতাশ করার চেয়ে পকেটে প্যাকেট রাখাই ভালো!
ট্রেন ছাড়ল নির্দিষ্ট সময়েই। এসি কেবিন, বন্ধ কাছের জানলায় ওপাশে হৈচৈ, তাড়াহুড়ো, হকার, ভিখারি।
রুপা বলল, “দিনের বেলা হলে, দেখতে দেখতে যেতে পারতাম!”
“ফেরার দিন দিনের ট্রেনেই ফিরব। আশা করি, ততোদিন তাহমিনা হায়াতের নাড়ির খবর পর্যন্ত জেনে যাবো! নিজেদের মতো ফেরা যাবে”, ব্যাকপ্যাকটা রুপার পাশে রেখে লোয়ার বার্থে গা এলিয়ে দিল নির্জন।
তাহমিনাদের কেবিন বিপরীত দিকের দুটো কেবিন পরেই। নির্জন দেখেছে, করিডোর দিয়ে ঢোকার সময়, বেশিরভাগ কেবিনই ফাঁকা। এত কাহিনী করে তবে টিকিট কাটতে হলো কেন?
“মিসেস জুলফিকারের সাথের লোকটিকে দেখেছো?”, রুপার দিকে তাকিয়ে বলল নির্জন।
“হ্যাঁ। ভদ্রোলোক বেশ হ্যান্ডসাম, লম্বা!”, রুপা বলল।
“মুখটা খেয়াল করেছো?”
“হ্যাঁ”, বলল রুপা। “কর্কশ একটা ভাব আছে। ম্যানলি!”
নির্জন বলল, সকৌতুক, “ম্যানলি? তাই নাকি? হতে পারে, নারীর চোখে তো দেখিনি! তবে ওর ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিটা দেখেছি। মুখটা আজ অনেক বেশি ফোলা লাগছে।“
“তা একটু মনে হলো বটে! কিন্তু…”, চোখ সামান্য কুঁচকে ভাবুক গলায় বলল রুপা।
“এখন রাত প্রায় দশটা, কোনভাবেই ঘুম থেকে ওঠার সময় নয়!”
“তারমানে অসময়ে ঘুমিয়েছিলেন লোকটা! কাণ্ডজ্ঞানহীন!”, চট করে বলল রুপা!
সামান্য বিরক্ত হয়ে, জোর গলায় বলল নির্জন, “মানে ভদ্রলোক হেভি ড্রিংকার- ডিহাইড্রেশনের কারণে মুখ ফুলেছে! সামনের দাঁতেও একটু ছোপছোপ দাগ! একটু অন্যভাবে ভাবতে শেখো, রুপা!”
রুপা নির্জনের দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। রুপার মুখের ভাব বুঝতে পারল না চোখদুটিই শুধু দৃশ্যমান থাকায়। নির্জনের ডিডাকশনে যে খুব বেশি ভরসা নেই ওর, বুঝতে পারল চাহনি দেখেই!
রুপা বলল, “চারজন যাওয়ার কথা! বাকি দুজন কোথায়? এলো না যে?”
নির্জন হাসল। বলল, “ওরা হয়তো আলাদাভাবে যাচ্ছে। জুলফিকার সাহেবের সন্দেহ যদি সঠিক হয়ঃ মিসেস জুলফিকার আর ঐ ভদ্রলোকের মধ্যে যদি সত্যিই এফেয়ার থাকে, তাহলে হয়তো এরমধ্যেই হানিমুন শুধু হয়ে গিয়েছে!”
রুপা উঠল। কফি অর্ডারের নাম করে একবার দেখে এলো ওদের কেবিনটা। ফিরে এসে বলল, “না, এখনো দরজা লাগায়নি!”
“লাগাবে!”, দ্ব্যর্থবোধক সকৌতুক গলায় বলল নির্জন। “লাগানোর জন্য সারাটা রাত বাকি!”
হাসল বোধহয় রুপা, নির্জন দেখতে পেল না ওর মুখটা হিজাবের আড়ালে।
পাখিদের উপর তাহমিনা হায়াতের গতবছর প্রকাশিত একটা গবেষণাপত্র পড়তে লাগল নির্জন। পরশু ওর ইউনির ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে প্রিন্ট করে নিয়েছে। কালও পড়েছিল রাতে ঘুমানোর আগে। খানিকক্ষণ বাদে বলল, “আমি তাহমিনা হায়াতের স্বামী হলেও জুলফিকার সাহেবের মতো সন্দেহ করতাম!”
হিজাব সরিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল রুপা। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
“তোমার মেথডোলজি কোর্স ছিল অনার্সে?”, উল্টো প্রশ্ন করল ওকে নির্জন।
“হ্যাঁ। থার্ড সেমিস্টারে।”
“তাহলে তোমার জানার কথা, রিসার্চ মূলত দুই প্রকার। কোয়ালিটেটিভ আর কোয়ানটিটেটিভ, তাই না?”
নিরুত্তর থেকে রুপা চুমুক দিল ধোঁয়া ওঠা কফিতে।
“কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ মূলত পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি নির্ভর। কোনধরণের ম্যাথের, স্ট্যাটিস্টিকের প্রয়োজন হয় না। রিসার্চারের পর্যবেক্ষণই এধরণের রিসার্চের মূল। আসলে এসব কথাটা সিগারেট ছাড়া হয় না!”
কথার মাঝে থেমে সিগারেট জ্বালল নির্জন ডলফিন কোম্পানির ম্যাচ জ্বেলে। দুতিনটা টান পরপর দিয়ে বলতে শুরু করল, “অন্যদিকে কোয়ানটিটেটিভ রিসার্চে স্ট্যাটিস্টিক বাধ্যতামূলক, এধরণের রিসার্চে সাধারণত তুলনা করে দেখানো হয়। আগের অবস্থা, বর্তমান অবস্থার পার্থক্য নির্ণয় করা হয়, পরিবর্তনের হার বের করা হয় ইত্যাদি! সায়েন্টিফিক রিসার্চগুলো হয় মূলত কোয়ানটিটেটিভ!”
“এর সাথে তাহমিনা হায়াতকে সন্দেহ করার সম্পর্ক কী?”, অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল রুপা!
“কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ সাধারণত সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, লিংগুয়েস্টিক ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়। খারাপ বলছি না, তবে এই রিসার্চ পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। কারণ এতে হিসেব নিকেশের কোন বালাই নেই। রিসার্চারের পর্যবেক্ষণ অনুভূতিই এখানে মুখ্য আর সেটা ভ্যারি করতে পারে রিসার্চারের মানসিকতা ভেদে! বাংলাদেশের বেশিরভাগ রিসার্চার এই কোয়ালিটেটিভ রিসার্চই করেন কারণ তারা স্ট্যাটিসটিক্স পারেন না!”
“হ্যাঁ তো?”, ধৈর্য্যচুত্য রুপার প্রশ্ন।
রুপার বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে নির্জন বলেই চলল, “তাহমিনা হায়াতের এই রিসার্চটা কোয়ালিটেটিভ! তিনি তো সোশ্যাল সায়েন্সের রিসার্চার নন; ওরাও এখন কোয়ানটিটেটিভ রিচার্স করেন। তাহমিনা লাউয়াছড়ায় পাখিদের বাসস্থান আর পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রকাশও করেছেন সেটা। লিখেছেন, দিনদিন পাখিদের আবাস কমে যাচ্ছে। কিন্তু কী হারে কমছে, কোথায় কমেছে কিংবা আগে পরিযায়ী পাখিরা কী পরিমাণে আসত, এখন কী পরিমাণে আসছে, তার কোন হিসেব নাই! তাহলে কী করে বুঝব কমছে সংখ্যা? এমনকি পাখির সে ছবি লাগিয়েছে পেপারে, সেসব ছবিও তার তোলা নয়! কাল রিভার্স সার্চ করে দেখেছি, ছবিগুলো সব ফ্লিকার থেকে সংগ্রহ করা!”
রুপার মুখটা এবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বলল, “তারমানে দাঁড়াল…”
রুপাকে কথা শেষ করতে দিল না নির্জন; জিজ্ঞেস করল, “সুন্দরবনের বাঘ গগনার উপায়টাকে কী বলে, জানো?”
উত্তরের জন্য রুপার মুখের দিকে তাকাল নির্জন। ভ্রু কুঁচকে গেল রুপার। নির্জন বলল, “পাগমার্ক। পাগ মানে হিন্দিতে পা। পায়ের ছাপ চিহ্নিত করে বাঘ গণনা করা হয় বলে পদ্ধতিটাকে পাগমার্ক বলে। পাগমার্ক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না রেখেও বলে দিতে পারি, দিনদিন সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমছে! বলতে পারি, নদীতে শুশুকের, সমুদ্রে তিমির সংখ্যা কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব তো পড়বেই প্রকৃতিতে! এজন্য কি গবেষণা প্রয়োজন? তাহমিনা ঠিকমতো গবেষণা করলে পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থানের সংখ্যা, তাদের বিচরণভূমির পরিমাণ ইত্যাদি সংখ্যায় উল্লেখ করতেন।“
থামল নির্জন। রুপার ওর দিকে তাক করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে ছাড়ল একবুক ধোঁয়া। তারপর বলতে শুরু করল, “এস করেননি তিনি, কারণ জানেন না। এসব না করে, উল্টো ভূমিকায়, যে বহুজাতিক কোম্পানি তাদের সেই রিসার্চ স্পন্সর করেছিল, তাদের প্রশংসা করেছেন আধপাতা, সে কোম্পানির এমডিকে ধন্যবাদ জানাতে খরচ করেছেন কয়েকশো শব্দ! এটাকে গবেষণা বলে?”
“আপনি তাহলে বলতে চাচ্ছেন”, রুপা বলে, “তাহমিনা আসলে গবেষণা করেননি?”
নির্জন রুপার মুখের দিকে তাকাল, চোখ রাখল চোখে। বলল, “হ্যাঁ!”
তারপর তাহমিনা হায়াতের কেবিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কোনভাবেই বার্ড ওয়াচার বাঁ পক্ষীবিশারদ নই! আমার কাছেই যদি এটাকে বোগাস মনে হয়, যারা এব্যাপারে এক্সপার্ট, তাদের কাছে এই গবেষণার মূল্য কতটুকু?”
“বুঝতে পেরেছি!”, বলল রুপা। ট্রেন থেকে দেয়া লেপটাকে জড়িয়ে নিল শরীরে।
নির্জনের মাঝেমাঝে মনে হয়, ওর একজন ডক্টর ওয়াটসন প্রয়োজন। এই যে এত বড় লেকচার দিল রিসার্চ নিয়ে, রুপা ছাড়া কেউ শুনল না! রুপাও হয়তো এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দিয়েছে- লিখে রাখা দূরে থাক!
অবশ্য লিখে রাখার মতো কেইস’ই বা নির্জন পেল কোথায়!
কোনান ডয়েলের লেখা নিয়ে সিনেমা হয়েছে প্রচুর। ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ নিজেই সিনেমা করেছেন, এখনও সিনেমা হচ্ছে। গোয়েন্দা নির্জনকে নিয়ে সিনেমা হলে? হাসল নির্জন, “নির্মাতাকে ছবি থিয়েটারের বদলে পর্নহাবে মুক্তি দিতে হবে!”
ট্রেন থামল বিমানবন্দর স্টেশনে। বাইরে চেঁচামেচি, ঠ্যালাঠেলি, গার্ডের হুইসেল, “এই মধু লাগবে মধু, সুন্দরবনের খাঁটি মধু”, ভিক্ষুক, “আল্লাহ’র নামে একটা টাকা দেন, বাজান!”
কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো নির্জন। করিডোরে কেউ নেই। তাহমিনা হায়াতের কেবিনটা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। এখনো কেবিনটাকে উন্মুক্ত রেখেছে ওরা। কতক্ষণ থাকে সেটাই দেখার বিষয়!
আরেকটা সিগারেট জ্বালল নির্জন, করিডোরে দাঁড়িয়েই। সকালে সারাদিন সিগারেট ছোঁবে না- এমন ছেলেমানুষি পণ করেছিল! কেন, কে জানে! গোটা পৃথিবীতে নিকোটিন বিরোধী মুভমেন্ট চলছে। ছোটবেলায় দেখেছে, ট্রেনের সিটে বসেই দিব্যি সিগারেট খাচ্ছে লোকে। এখন দরজার কাছে এসে খেতে হয়; একটা স্মোকিং জোন পর্যন্ত নেই! নিকোটিন বিরোধী প্রচারণা এত বেশি যে, বিবিসির “শার্লোক” এ পরিচালক শার্লককে নন স্মোকার হিসেবে তুলে ধরেছে! বেনেডিক্ট ক্যামবারব্যাচকে একবারও পাইপ হাতে দেখা যায়নি। পাইপ ছাড়া শার্লোককে কল্পনা করা যায়?
আবারও মিসেস জুলফিকারের কেবিনের দিকে আড়চোখে চাইল নির্জন। জুলফিকার সাহেব কাল ফোন করে জানিয়েছেন, শ্রীমঙ্গলে হোটেল নিসর্গতে থাকবে ওরা। তিনি নিজেই বুক করে দিয়েছেন দুটো রুম ফোন করে। রুম নাম্বার ৩০৭, ৩০৮। ট্রেন থেকে নেমে ওরা হোটেল নিসর্গতেই চলে যাবে সরাসরি। তিনতলাতেই রুম নেয়ার চেষ্টা করবে, না পেলে দেখবে অন্য ব্যবস্থা!
ট্রেনটা চলতে আরম্ভ করল একটা দুলুনি দিয়ে। অজগরের মতো হেলতে দুলতে ছেড়ে যাচ্ছে বিমানবন্দর স্টেশনের প্লাটফর্ম। লোকজনের হাঁকডাক, ভিক্ষুকদের কাঁতর কণ্ঠ, গার্ডের হুইসেল, “সাবধানে”- সবকিছু মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের অবিরত শব্দে। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেলো তাহমিনাদের কেবিনে। এখন, ফোনের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে ওরা দুজন, মিসেস জুলফিকার হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছেন ডক্টর মনোযার ওমরের গায়ে।
ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করল নির্জনের পকেটে। সাইফা।
“আগামী মাসে সুইডেন যাওয়া কনফার্ম মোমিনের! ভালোই হলো, এখন ঢাকার বাইরে যাচ্ছো তুমি! মোমিন সুইডেনে গেল আর তুমি ঢাকার বাইরে- কী অবস্থা হতো ভাবতে পারো?”, কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল সাইফা। এখনো মোমিন আটকে আছে একটা অনুষ্ঠানে, ঘুমিয়েছে ছেলেটা।
“কী আর হতো? তোমাকে চোদন না খেয়ে কয়েকটা দিন কাঁটিয়ে দিতে হতো!”, আশেপাশে তাকিয়ে বেশ নিচু স্বরে বলল নির্জন।
“হুম।”
“তোমার স্বামীকে বলো, সুইডেন থেকে ইম্পোর্টেড ভাইব্রেটর, ডিলডো নিয়ে আসতে। তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না!”, হেসে বলল নির্জন।
“আমার ওসব আর্টিফিসাল জিনিসে হয় না। আমার মানুষ চাই, বুঝলে। মানুষের বাড়া’ই চাই!”। বলল সাইফা হালকা গলায়।
“তোমার এত খাই খাই হয়েছে কেন বলতো? বিয়ের আগেও এমন ছিলে?”
“না গো!”, বলল সাইফা, “এখন যেন কেমন হয়ে গেছি! বিয়ের আগে তো চোদাচুদির কথা চিন্তাও করতাম না। তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার এমন হয়েছে! আগে আমি কতো ভালো ছিলাম!”
“আগে চুদতে ইচ্ছে করত না?”
“করত না আবার!”, বলল সাইফা, “কিন্তু এখনকার মতো সারাদিন এসব নিয়ে ভাবতাম না!”
কিছু বলল না নির্জন। দেখল, তাহমিনা হায়াত লেপ চাপিয়ে পা ছড়িয়ে লোয়ার বার্থে হেলান দিয়ে শুয়েছে, কানে লাগিয়েছে ইয়ারফোন। মনোয়ার ওমর ফোনে কথা বলছেন যেন কার সাথে, তার পায়ের কাছে বসে।
“থাক সেসব কথা। আমার পরিকল্পনা শোন। আমি ভেবে দেখলাম, আমার লেখালেখি করা উচিত। সারাদিন তো বসেই থাকি, কী বলো?”
নির্জনের মনে হলো, ভুল শুনছে ও। বলল, “কী করবে বললে? লেখালেখি?”
“হ্যাঁ। সেদিন মোমিনের বিসিএস ব্যাচের অনুষ্ঠানে গেলাম না তোমার ওখান থেকে? অনেকের সাথেই কথা হলো! মোমিনের ব্যাচের অনেকের বৌ লেখালেখি করে। বইমেলায় বই ছাপায়, বই প্রকাশের অনুষ্ঠান করে, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের গিফট করে। আমিও ভাবছি, বই লিখব, কী বলো?”
এতোটা হতভম্ভ অনেকদিন হয়নি নির্জন। বলতেই পারল না কিছু! এমনকি ভুলে গেল মিসেস জুলফিকারের কেবিনের দিকে নজর রাখতেও।
“কী? কথা বলছো না যে?”, ওপাশ থেকে তাগিদ সাইফার।
“এটাই বাকি ছিল আরকি!”, বলল নির্জন। “আমলার স্ত্রী হয়ে বই প্রকাশ করবে না, তা আবার হয় নাকি? করে ফেলো!”
খোঁচাটা ধরতে পারল না কিংবা গায়ে মাখল না সাইফা। বলল, “আমি কাহিনীও পেয়েছি একটা। শুনবে?”
“কী কাহিনী শুনি!”
“প্রেমের উপন্যাস আরকি। একটা ছেলে আর মেয়ের প্রেম! কিন্তু ছেলেটা গরীব। মা বাবা নেই। মেয়েটার বাবা বিসিএস ক্যাডার, মা ডাক্তার। মেয়ের মাবাবা কোনভাবেই তাদের প্রেম মেনে নেয় না। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ওরা। অনেক কষ্ট হয় ওদের। ছেলেটা কারখানায় কাজ করে, মেয়েটা রান্নাবান্না করে। ওদের একটা বেবি হয়। সেই বেবিকে দেখতে পায় একদিন মেয়েটার বাবা। বাবার মন গলে যায়। উনি তখন মেনে নেয় বিয়েটা। ছেলেটাকে একটা ভালো চাকরি পাইয়ে দেয়। তারপর ওরা সুখে শান্তিতে ঘর করে!”
নির্জনের মনে হতে থাকে, ওর কানে কেউ যেন ফুটন্ত তরল সীসা ঢালছে। হাসি ধরে রাখাও কষ্টকর হয়ে যায় ওর জন্য। কোনমতে হাসি সামলে, বলে, “বাঃ দারুণ গল্প! প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, বাঁধা বিপত্তি আছে আর আছে হ্যাপি এন্ডিং। জমে যাবে একদম!”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে! কিন্তু কাহিনীটা মোমিনকে শোনালাম। ও বলল, এমন নাকি অনেক গল্প আছে!”
নির্জন বলল, উদ্রেক হওয়া অট্টহাসি আটকে, “লাখ লাখ প্রেমের গানও আছে, তাই বলে নতুন প্রেমের গান মানুষ লিখছে না? বিভূতিভূষণ প্রেমের গল্প লিখেছে, বুদ্ধদেব বসু লিখেছে, তুমিও ওদের দলে সামিল হলে!”
“কার কথা বলছো? বুদ্ধদেব বসু? উনি খুব ভালো প্রেমের গল্প লিখেন, তাই না? আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে ওনার, অটোগ্রাফ নেব?”
ফোনটা কেটে খ্যাখ্যা করে উচ্চগ্রামে হেসে উঠল নির্জন।